অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন
নির্দিষ্ট খাতনির্ভর রাজস্ব সংগ্রহ আর্থিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে

মেসবাহুল হক
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
অর্থ বিভাগের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই সময়ে এনবিআরের মোট রাজস্বের ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশ এসেছে মূসক বা ভ্যাট থেকে। আয়কর খাত থেকে এসেছে ৩০ দশমিক ২১ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক থেকে ১৪ দশমিক ৩৭, আমদানি শুল্ক থেকে ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২ শতাংশের কিছু বেশি এসেছে আবগারি, রপ্তানি শুল্ক ও অন্যান্য কর থেকে। এভাবে কিছু নির্দিষ্ট উৎস থেকে কর আদায়ের নির্ভরতা আর্থিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই ঝুঁকি কমাতে রাজস্ব আয়ের নতুন নতুন উৎস খুঁজে বের করা দরকার।
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করভিত্তিক রাজস্ব বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির জন্য আদর্শ নয়। কারণ, এ ধরনের কর ধনী-গরিব সবাইকে সমানভাবে দিতে হয়। এতে করে দরিদ্র মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যাঁর দৈনিক আয় ২০০ টাকা, তাঁর ওপরও পণ্য কেনায় ভ্যাটের প্রভাব ১৫ শতাংশ। আবার যাঁর আয় ২ থেকে ৫ হাজার টাকা বা আরও বেশি, তাঁকেও একই হারে ভ্যাট দিতে হয়। এ ছাড়া কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যদি ভ্যাট আদায় কমাতে হয় তাহলে রাজস্বে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। তাই অন্যান্য খাতে রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন উৎস খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
এদিকে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে প্রায় ৩ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নিয়েছিল এনবিআর। যদিও এ সময়ের মধ্যে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্যের প্রায় ৮৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ আহরণ করতে পেরেছে সংস্থাটি। অর্থবছরের পুরো সময়ে সংস্থাটির রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে অর্থবছরের শেষ মাসে সংস্থাটিকে রাজস্ব আহরণ করতে হবে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়কর, ভ্যাট এবং শুল্ক এনবিআর রাজস্বের প্রধান তিনটি খাত। এর মধ্যে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আয়কর খাতে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি কমে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তার আগের অর্থবছরে যা ছিল ১৬ শতাংশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এনবিআরের মোট রাজস্বের ৫৪ শতাংশই আসে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক থেকে। আয়কর খাত থেকে আসে প্রায় ৩৩ শতাংশ। আরও কয়েক খাত থাকলেও সেখান থেকে সামান্য রাজস্ব আদায় হয়। এসব খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানো উচিত বলে মনে করে অর্থ বিভাগ।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের কর কাঠামোর ভেতরে দুই-তৃতীয়াংশই পরোক্ষ কর। পরোক্ষ করের ওপর ভিত্তি করে কোনো সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। এসব কারণেই বৈষম্য বাড়ছে। কোনোভাবেই প্রত্যক্ষ কর এক-তৃতীয়াংশের ওপরে নিতে পারছে না সরকার। এসবের ব্যাখ্যা না করলে অর্থনীতিকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। পরোক্ষ কর ও ভ্যাটের ওপর নির্ভরশীলতা এবং সম্পদের ওপর কর না থাকা মৌলিক বৈষ্যমের একটি উৎস।
এ ছাড়া এনবিআর ব্যতীত অন্যান্য উৎস থেকে আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ মোট রাজস্বের ২ শতাংশের বেশি নয়। এর মধ্যে রয়েছে মাদক ও মদজাতীয় পণ্যের বিক্রি, যানবাহন, ভূমি উন্নয়ন এবং নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রি থেকে কর। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে এসব খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানোর সুপারিশ করেছে অর্থ বিভাগ। একই সঙ্গে সরকার থেকে প্রদত্ত বিভিন্ন সেবার বিপরীতে প্রদত্ত ফি বাস্তবতার নিরিখে হালনাগাদ করে যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করার বিষয়েও বলা হয় এতে।
এদিকে সদ্য শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ ধরা হয়েছে ভ্যাট থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ।
বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মোট রাজস্বের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ আয়কর, ১৪ দশমিক ১ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১০ দশমিক ৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং ১ দশমিক ৪ শতাংশ অন্যান্য খাত থেকে আসবে। গত অর্থবছরের বাজেটে সম্পূরক শুল্ক থেকে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, আমদানি শুল্ক থেকে ১১ দশমিক ৯ এবং অন্যান্য খাত থেকে ১ দশমিক ৪ শতাংশ রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।