ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

আইএমএফকে সরকারের প্রতিশ্রুতি

অর্থনীতিতে সংস্কার জোরদার হবে নির্বাচনের পর

অর্থনীতিতে সংস্কার জোরদার হবে নির্বাচনের পর

ওবায়দুল্লাহ রনি ও মেসবাহুল হক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৩ | ১৯:০৪ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ০৩:৩৫

আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কারে যেতে চায় না সরকার। নির্বাচনের পর ব্যাংকের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া এবং জ্বালানি তেলের দর আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের মতো সংস্কারে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দলকে দেওয়া হয়েছে।

এসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের জন্য কিছু সংস্কার কার্যক্রম শুরুর সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আইএমএফকে অনুরোধ করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আইএমএফের পরামর্শ মেনে এরই মধ্যে কিছু সংস্কার করা হয়েছে। বিশেষ করে, সুদহার আগের মতো আর ৯ শতাংশে নির্ধারিত নেই। ডলারের বিনিময় হারেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কমানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। আইএমএফের শর্ত পরিপালন না হওয়ার বড় কারণ হলো, সংকট থাকায় রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বাজারে বিক্রি করতে হয়েছে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার বিক্রি বন্ধ করলে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে এসব বিষয় বোঝানোর পর তারাও অনেক ক্ষেত্রে আশ্বস্ত হয়েছে। ফলে রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে না পারায় দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় আটকাবে না বলে আশা করা যায়।

জানা গেছে, সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, নীতি সুদহার বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে সফররত দলটি নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় থেকে।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আগামী মাসে ছাড় হওয়ার কথা। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার অন্যতম হলো– বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ গত জুন নাগাদ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকতে হবে। কিন্তু সেই শর্ত পালন করা সম্ভব হয়নি। রিজার্ভ কমে এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়েছে। বিনিময় হার ও সুদহার বাজারভিত্তিক করার শর্ত থাকলেও সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ রয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল সকালে ১৩টি ব্যাংকের এমডির সঙ্গে বৈঠক করে। এর পর দুপুরে ২৭টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুটি বৈঠকেই ব্যাংকগুলো কোনোভাবে যেন এবিবি ও বাফেদা নির্ধারিত ১১০ টাকার বেশি দরে ডলার না কেনে, সে বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরা হয়।

এমডিদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত দর কঠোরভাবে মেনে চলতে বলা হয়েছে। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অগ্রাধিকার। নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে কলমানি, আমানত, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার যে বাড়ছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এভাবে সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে বাজারে তারল্য কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তাদের লক্ষ্য। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। তবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে খেলাপি ঋণ আদায় অনেক সময়সাপেক্ষ।

নির্বাচনের পর বিদ্যুৎ-জ্বালানির দর সমন্বয়

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানির দর নির্ধারণের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধিত চালু করার কথা। এ জন্য একটি ফর্মুলা প্রস্তুত করে জ্বালানি বিভাগে জমা দিয়েছে বিপিসি। সেখানে তিন মাস বা এক মাস পরপর দর সমন্বয়ের কথা বলা হয়। এটি কার্যকর করলে জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়তে পারে। সামনে নির্বাচনের আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেবে না সরকার। এ পদ্ধতি কার্যকরে আরও তিন মাস সময় চাওয়া হয়েছে। আইএমএফ প্রতিনিধি দলও তাতে সম্মতি দিয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে বাজেট ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক রাখতে সার্বিকভাবে ভর্তুকি কমিয়ে আনার শর্ত রয়েছে। ভর্তুকির অধিকাংশই যায় বিদ্যুতে। ভর্তুকি কমিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সরকার কয়েক দফা দাম বাড়িয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে বিদ্যুতের দাম আর বাড়াতে চায় না সরকার। নির্বাচনের পর জ্বালানির দর নির্ধারণের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হলে বিদ্যুতেও ভর্তুকি কমবে। দাম সমন্বয়ের মাধ্যমেও ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ভর্তুকি ও ধার কমানোর জোরালো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

শর্ত অনুযায়ী, সরকারকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। তবে নির্বাচনী বছরে এ লক্ষ্য) অর্জন কঠিন। যে কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে কী পরিমাণ করছাড় কমানো হবে, তা উল্লেখ করার শর্ত দেওয়া ছিল। নির্বাচনের পর রাজস্ব আহরণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অটোমেশন বাস্তবায়নসহ করছাড় কমানোর উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে বলে অর্থ বিভাগ আইএমএফ মিশনকে জানিয়েছে।

আরও পড়ুন

×