ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সিপিডির বাজেট সংলাপে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী

সূক্ষ্ম সুশাসন নয়, জনগণ চায় ভালো পানি-রাস্তা-ল্যাট্রিন

সূক্ষ্ম সুশাসন নয়, জনগণ চায় ভালো পানি-রাস্তা-ল্যাট্রিন

সিপিডির বাজেট সংলাপে বক্তব্যকালে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। ছবি-সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪ | ১৬:৪৯ | আপডেট: ১২ জুন ২০২৪ | ১৯:১৯

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণ সূক্ষ্ম সুশাসন, গণতন্ত্র চায় না। তারা চায় আরও বেশি প্রকল্প, আরও ভালো পানি, আরও ভালো রাস্তা, আরও বেশি স্কুল। গ্রামের দরিদ্র শ্রেণির ভোটাররা টিউবওয়েল, ল্যাট্রিন চায়, ছেলে-মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি চায়। এই যখন বাস্তবতা, তখন বিরোধীদলের ভাইয়েরা বলছেন, দেশে গণতন্ত্র নাই, সে কারণে আপনারা আসতে পারছে না, এটা বলে আপনার জাতির প্রতি দায়িত্ব অবহেলা করছেন।

বুধবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি আয়োজিত ‘সিপিডি বাজেট সংলাপ ২০২৪’ এর আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। 

আলোচনায় বিরোধীদলীয় উপনেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান ও রাশেদা কে চৌধুরিসহ আরও অনেকে অংশ নেন। বাজেট নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

বর্তমান সরকারের উন্নয়নের রহস্য ধারাবাহিকতা, আর্থসামাজিক ও নীতির স্থিতিশীলতা- এমন মন্তব্য করে এমএ মান্নান বলেন, আমাদের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা উন্নয়নের পথে হাঁটবে। এটা আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, ঘোষণা। আমরা স্বাধীন ও সম্মানিত অর্থনীতির দেশ হতে চাই। 

তিনি বলেন, অথচ আমাদের বিরোধী দলের লোকেরা মাঠে থেকেও থাকেন না। তারা কী গণতন্ত্রের, সুশাসনের চর্চা করছেন? আমরা সরকার করছি। আপনি বিরোধীদল মাঠে আসছেন না। আপনি ‘অন এন্ড অব পলিটিক্স’ করবেন। একবার সংসদে আসলেন, একবার আসবেন না। একবার মাঝ পথে চলে যাবেন। কখনো নির্বাচনের বিরোধিতা করবেন, আগুন দেবেন, রেললাইন উপড়াবেন পাত উঠাবেন... এসব বর্জন আপনাদের যদি অফিসিয়াল ঐক্য হয় দেশকে অস্থিতিশীল করবেন, আমি বলবো, আনফরচুনেটলি আপনারা এটা পারবেন না। বাংলাদেশের জনগণ এটা গ্রহণ করে নাই। 

তিনি আরও বলেন, মোটা দাগে আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণ সূক্ষ্ম সুশাসন, আরেক বোতল গণতন্ত্র চায় না। তারা চায় আরও বেশি প্রকল্প, আরও ভালো পানি, আরও ভালো রাস্তা, আরও বেশি স্কুল। 

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে রাজনৈতিক দল জনগণকে সাথে নিয়ে ভালো চর্চা করবে- এটাই নিয়ম। আমরা যে ন্যায্যতা চাই, আধুনিকতা চাই, অসাম্প্রদায়িকতা চাই... সেগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে। এজন্য সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগ মাঠে আছে, কখনো ছাড়ে নাই, ভবিষ্যতেও ছাড়বে না। রাজনৈতিক নেতা নয়, একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসাবে বলবো, সময় হয়েছে, আসুন, বসুন। সব কিছু সমাধান সম্ভব।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে সমালোচনার জবাবে এমএন মান্নান বলেন, আমাদের মূল্যস্ফীতি আছে। তবে এটা ক্রিপিং-ক্রিপিং মানে পায়ে পায়ে হাঁটছে। এটা যদি সবল হতো, তার ফল হতো অচিন্তনীয়। এই যে দমন করে রাখা এটা আমাদের অর্থনীতির শক্তি, আমার নয়। মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধিরই একটি ফল। একটা ছাড়া অন্যটা হয় না। মূল্যস্ফীতি যেমন হচ্ছে, তেমনি বেতনবৃদ্ধিও হচ্ছে। তার মানে ছোবলটা একটু কমছে। কার্ড, সাশ্রয়ী মূল্যে ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য দিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষকে টার্গেট করে সহায়তা দিচ্ছি। আমাদের মধ্য ও উচ্চবিত্তরা হয়তো সরাসরি এসব অনুভব করতে পারছে না, তবে পরোক্ষভাবে করছেন। যদি নিম্ন আয়ের মানুষদের টার্গেট করে ব্যবস্থা না নিতাম, তাহলে মূল্যস্ফীতি ১৫-১৬ শতাংশ হয়ে যেতো। তার থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি সরকারের উদ্যোগের কারণে। প্রবৃদ্ধি চাইলে মূল্যস্ফীতি সইতে হবে। এক সময় এটা কমে আসবে, এই ঝুঁকি আমাদের নিতে হবে। বড় অর্থনীতিগুলো এভাবে এগিয়েছে। 

মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ভ্যাট আরোপ নিম্নবিত্ত ও মধ্য বিত্ত মানুষের কষ্ট বেড়েছে- এ যুক্তি মানতে রাজি নন এমএ মান্নান। তিনি বলেন, আমি ভ্যাটের সমর্থক। অনেকে বলেন, গরীবের ওপর কেনো চাপানো হলো। আসলে এটা অজান্তে হয়, যার ওপর চাপে সে টেরও পায় না। গরীবের জন্য চাল, ডালে ভ্যাট নেই। অন্যগুলো যা আমরা সবাই ব্যবহার করি, সেগুলোর ক্ষেত্রে ৫০টাকার মালে ৫ টাকা ভ্যাট থাকলে বোঝা যায় না।

তিনি বলেন, আমাদের মূল অর্থনীতি, যার মূলে আছে কৃষি, গত দেড়-দুই দশকে তার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, এটা আমাদের স্বীকার করা প্রয়োজন। চাল, ভুট্টা উৎপাদনে আমরা কোথায় পৌঁছেছি, তা এক কথায় অবিস্মরণীয়। মিঠা পানির মাছে আমরা চীনকে ছাড়িয়েছি। সামাজিক নিরাপত্তা আমাদের সরকারের অভাবনীয় উদ্ভাবন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে এটা শুরু করেন। শহুরে মানুষের হিসাবে সামান্য হলেও গ্রামের মানুষের জন্য এ সহায়তা বিশাল অবদান রাখে। এ বাজেটে এ খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্বল্প মূল্যে খাদ্য বিক্রির কার্ড এখন এক কোটি। মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, এটা বাড়াবেন এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষকে এর আওতায় আনবেন।
 
সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) থেকে আমরা কী পাচ্ছি, জনগণ কতটা উপকার পাচ্ছে, তার মূল্যায়ন হতে পারে বলে মত দেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, ‘আমরা বাস করি বোতলে, বিনিয়োগ করি পাতালে’। আমরা চাহিদা ও যোগান দুটোকেই নষ্ট করি।

অর্থনীতির এ চাপের সময় কিছু মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে বলেও অভিমত প্রকাশ করেন সাবেক পরিকল্পনমন্ত্রী। তিনি বলেন, কিছু মেগাপ্রকল্প নিয়ে আমি খুবই ‘এক্সাইটেড’। যেমন- পদ্মা সেতু আরও চারটা হলে আপত্তি নাই। আরও দশটা হলেও আমার আপত্তি নাই। আর এগুলো নিয়ে আমার মনে কোনো সমস্যা নাই। কিছু থাকলে আপনাদের থাকতে পারে, তা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু কিছু মেগা প্রকল্প এখন সময় বিবেচনায় বিলম্বিত করা যেতে পারে- আমি স্বীকার করি। আমাদের যুবক ও শিক্ষার্থীরা পারমানবিক বোমা নয়, শক্তি চায়। এ কারণে রূপপুরে গিয়েছি। এটা কোনো বিনাশী মেগাপ্রকল্প নয়। এটা আমাদের আড়াই হাজার মেগাওয়াট গ্রিন-ক্লিন বিদ্যুৎ দেবে। এ বছর দেবে সাড়ে ১২শ, ২০২৬ সালে আরও সাড়ে ১২শ। প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণবঙ্গে আরও একটা করতে চান। এগুলো নিয়ে সমস্যা নাই। হ্যাঁ, সরকারের অনেক কাজের মধ্যে দু’একটা প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। 

তবে মেগা প্রকল্পের উচ্চ ব্যয় নিয়ে সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, কথায় কথায় কেউ কেউ বলেন, প্রকল্প ব্যয়ে আমরা নাকি বিশ্বে সর্বোচ্চ। আরে উত্তর প্রদেশের মাটি বা বিহারের মাটি, ঝাড়খণ্ডের মাটি, গুজরাটের মাটি কোথায়? আমাদের তো সড়ক বানাতে গেলে ২০ ফুট উঁচু করতে হয় মাটি দিয়ে। আমি হাওরের ছেলে। তিন বার, চার বার, পাঁচবার মাটি না নিলে মাটি টেকে না। কোথায় এটা ইন্ডিয়াতে আছে?  চায়না বা বার্মাতে আছে? তাদের তো জমিও কিনতে হয় না। আমাদের জমি কিনতে হয়। এসব নির্মাণ খরচ বিবেচনায় নিলে (আমি গবেষণা করি নাই) মনে করি না, বেশি খরচ করছি।

সবশেষে এমএ মান্নান বলেন, উন্নয়নের মূল্যবান অনুষঙ্গ কী? আমরা সম্পূর্ণ কমিউনিস্ট বা সোশালিস্ট ওই সমাজের কথা চিন্তা করছি না। আমরা উদার গণতন্ত্রে, উদার পুঁজিবাদ, আমরা ওয়াশিংটন কনসসাসে, আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে কর্তা মেনে, প্রাইভেট খাতকে গুরু স্বীকার করে চলছি। এর মধ্যে সব কিছু আমাদের চাহিদামত হবে, আমরা সর্বোচ্চ ন্যায্যতা অর্জন করতে পারবো, তা অসম্ভব বলে আমি মনে করি।

আরও পড়ুন

×