গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে তীব্র বিরোধিতা, হট্টগোল

রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে আয়োজিত শুনানি চলাকালে বিক্ষোভ হয়েছে। ছবি: সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ২০:৫৪ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ২২:০৩
শিল্পে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে শুনানিতে অংশ নিয়ে তীব্র বিরোধিতা করেছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। শুনানি শুরুর আগেই এটি বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন হয়। এরপর বুধবার রাজধানীর ইস্কাটনের বিয়াম ফাউন্ডেশনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানি চলাকালে স্লোগান দিয়ে আপত্তি জানান সংক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী ও ভোক্তা প্রতিনিধিরা, দেখা দেয় হট্টগোল।
নতুন শিল্পকারখানার জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য, বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার এলএনজির আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। ভ্যাট-ট্যাক্সসহ অন্যান্য চার্জ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে অর্ধেকেরও কম দামে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এ খাত টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাস কেনাবেচার ব্যবধান কমাতে হবে।
শুনানিতে প্রস্তাব অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে ব্যবসায়ীরা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। তাদের ভাষ্য, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে না। চালু কারখানাও বন্ধ হয়ে যাবে।
শুনানি বাতিলের দাবিতে বিয়াম ভবনের সামনে সকালে মানববন্ধন করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
পরে শুনানিতে অংশ নিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব গণবিরোধী। এ প্রস্তাবের ওপর কোনো শুনানি হতে পারে না। প্রস্তাবটি আগামী রোববারের মধ্যে খারিজ করতে হবে। তা না হলে গণআন্দোলনে ঘটনাও ঘটতে পারে।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির উদ্দিন বলেন, ‘৩০ টাকা থেকে গ্যাসের দাম ৭৫ করার প্রস্তাব দিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আমরা কী বার্তা দিতে চাচ্ছি? আপনারা কী বলতে চাচ্ছেন, নতুন শিল্পের দরকার নেই? দয়া করে গ্যাসের দাম বাড়াবেন না।’
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ালে শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। তিতাসের সিস্টেম লস কমানো গেলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।’ তিনি বলেন, ‘পোশাক রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চলছে। তাই নতুন নতুন কারখানা স্থাপন ও পুরাতন কারখানার সম্প্রসারণ করতে হবে। ৭৫ টাকা দরে গ্যাস কিনে কেউ এ খাতে বিনিয়োগ করবে না। তাই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়া এখনই বন্ধ করা উচিত।’
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমইএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগ করে ফেঁসে গেছি। ব্যবসা বন্ধ করতে পারছি না ব্যাংক ঋণ থাকায়। গ্যাসে এখন যে ৩০ টাকা দিচ্ছি, তাই অনেক বেশি। আমরা গ্যাস পাচ্ছি না। অথচ আপনারা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। আপনারা ব্যবসাটা কী ভারতের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন?’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না। আওয়ামী লীগ সরকার গায়ের জোরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরই শিল্প খাতে ধস নামতে শুরু করে। ঠিকমতো গ্যাস না পাওয়ায় প্রত্যেক কারখানার উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। তৈরি পোশাক খাতের ২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দাম বাড়ানো হলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে ঠিকমতো সরবরাহের সক্ষমতা অর্জন করুন। নতুন করে দাম বাড়ানো হলে উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। কারখানা চালানো সম্ভব হবে না।’
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শিল্প, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান বাঁচাতে কীভাবে ২০ থেকে ২২ টাকা ঘনমিটার গ্যাস দেওয়া যায়, সে উদ্যোগ নিন। শিল্প বাঁচানোর জন্য হলেও গ্যাসের দাম কমানো উচিত।’
শুনানির শেষ পর্যায়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ‘একই খাতে দুই ধরনের দাম বৈষম্যমূলক। আমরা উপস্থিত বিভিন্ন পক্ষের কথা শুনেছি। লিখিত মতামত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সবার মতামত বিশ্লেষণ করে কমিশন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত জানাবে।’
শুনানিতে কমিশনের সদস্য (গ্যাস) মিজানুর রহমান, সদস্য (অর্থ, প্রশাসন ও আইন) আব্দুর রাজ্জাক, সদস্য পেট্রোলিয়াম সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ শাহিদ সারওয়ার উপস্থিত ছিলেন।