ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

পাচার অর্থ প্রসঙ্গে গভর্নর

যুক্তরাজ্যে আরও কিছু সম্পদ জব্দ হতে পারে

যুক্তরাজ্যে আরও  কিছু সম্পদ জব্দ  হতে পারে

আহসান এইচ মনসুর

 বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৫ | ০১:০৯

পাচার করা অর্থ ফেরতের বিষয়ে বাংলাদেশের সরবরাহ করা তথ্যে সন্তুষ্ট হয়ে এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে কিছু সম্পদ জব্দ হয়েছে। শিগগিরই আরও কিছু সম্পদ এর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। ব্রিটেনে যাদের সম্পদ জব্দ হচ্ছে, সে দেশের সরকার চাইলে তাদের অন্য যে কোনো দেশে থাকা সম্পদ এর সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে। গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। 

প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের যুক্তরাজ্য থেকে ফেরার পর এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গভর্নর সে দেশে অবস্থানের সময়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ১৭ কোটি পাউন্ড (প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা) মূল্যের সম্পদ ফ্রিজের আদেশ দেয় সে দেশের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি। এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা, ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান রহমান এবং ভাতিজা শাহরিয়ার রহমানের ৯ কোটি পাউন্ডের সম্পদ জব্দ করা হয়। 

সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কয়েকটি দেশের কাছে পারস্পরিক আইনি সহায়তা (এমএলএ) চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সবচেয়ে গভীরভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি কীসের ভিত্তিতে ফ্রিজ হয়েছে– এমন প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, ‘আমরা পারস্পরিক আইনি সহায়তা (এমএলএ) চেয়েছি। অর্থ পাচারকারীদের সম্পদের বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে কে কত টাকা লুট করেছে, কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা নিয়ে গেছে– এসব তথ্য তাদের দেওয়া হচ্ছে। আরও নতুন আবেদন যাচ্ছে। 

তিনি বলেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ। তবে সম্পদ ফ্রিজ না হলে তা বিক্রি করে অন্য দেশে নিয়ে যায়। এখন বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হতে যত বছরই লাগুক, সম্পদ বিক্রি করতে পারবে না। ফলে এটি প্রাথমিক অর্জন। এই সম্পদ আর স্থানান্তর হবে না। আরেকটি বিষয় হলো, কিছু ব্যক্তি ও পরিবারের ওপর বাংলাদেশের অর্থ আত্মসাতের যে দাবি আমরা করে আসছি, তার যে যথার্থতা আছে– যুক্তরাজ্যের পদক্ষেপ তার প্রমাণ।

তিনি বলেন, পাচারকারীদের বিষয়ে দেওয়ানি নাকি ফৌজদারি মামলা হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের ওপর। এ সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায়। ফৌজদারি মামলা প্রমাণের জন্য অনেক বেশি তথ্য-উপাত্ত দিতে হয়। পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকলে তখন দেওয়ানি মামলা করা হয়। তবে আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে একবার ফৌজদারি মামলা করলে আর ফেরানো যায় না। ফলে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থ ফেরতের বিষয়ে তিনি বলেন, ধাপে ধাপে এগোতে হবে। অর্থ ফেরত আনার দুটি উপায় আছে। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণের ভিত্তিতে অর্থ ফেরত আনা। আরেকটি হলো, সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ ফেরত আনা। তবে সব হবে কেস টু কেস ভিত্তিতে। সরকার আদালতের বাইরে সমঝোতা করতে চাইলে তখন দু’পক্ষের আইনজীবী বসে সমঝোতার চেষ্টা করবেন।
গভর্নর বলেন, দেশীয় সম্পদের জন্য লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে দেশের আদালতে মামলা হবে। আর বিদেশি সম্পদের জন্য দেশের বাইরে মামলা হবে। সরকার চাইলে এখনই আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারে। কবে নাগাদ মামলা হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়া তার নিজস্ব গতিতে চলে।  চাইলে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া যাবে। তবে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয় আছে।

যুক্তরাজ্যে সম্পদ জব্দ হলেও অন্য দেশে কেন হচ্ছে না– এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, খুব বেশি দেশে এমএলএ পাঠানো হয়নি। অন্য অনেক দেশের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তবে সবচেয়ে গভীর আলোচনা চলছে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে। তারা ডকুমেন্ট প্রস্তুতিতে বাংলাদেশকে সহায়তা দিচ্ছে। সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এ ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। তবে সে দেশে সরকার পরিবর্তনের পর অনেক সংস্থায় পরিবর্তন এসেছে। যে কারণে আবার নতুন করে আলোচনা করতে হচ্ছে।
গভর্নর বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আমরা একটি তহবিল করতে পারি। আবার অর্থ উদ্ধারে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানও তহবিল আনতে পারে। এভাবে অর্থ উদ্ধার হলে পরে তাদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ দিয়ে বাকিটা আমাদের ফেরত দেবে।’

ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রসঙ্গে
সন্দেহভাজন অর্থ পাচারকারীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, ‘যখনই আমি লন্ডনে যাচ্ছি তখনই ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে পাচারকারীরা হয়তো সবার দৃষ্টি তাদের দিক থেকে আমার দিকে ফেরাতে চায়। সেই চেষ্টায় তারা সফলও হয়। তবে আমার বক্তব্য পরিষ্কার। এগুলো বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে করা। এখানে কোনো সত্যতা নেই। 
তিনি বলেন, ‘আমার প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েরা কে কোথায় বাড়ি করবে, কোথায় বিয়ে করবে– তাদের বিষয়। এ নিয়ে আলোচনা একটি অযাচিত চর্চা। আমি এক পয়সা দেশের বাইরে নেইনি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি। বরং আইএমএফে চাকরির টাকায় বিদেশে করা সম্পদ দেশে এনেছি।’

কিছু ব্যাংক একীভূত হবে, কর্মীদের চিন্তার কিছু নেই
ব্যাংক একীভূতকরণ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, কিছু ব্যাংক একীভূত হবে। এতে কর্মীদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আলাদা একটি বিভাগ খোলা হচ্ছে। যাদের কাজ হবে যদি কোনো ব্যাংক নিজেদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, আগেই ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারীকরণের মাধ্যমে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ করা হবে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের আগে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ হবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার মিলে একীভূতকরণ করে থাকে। এ জন্য অর্থের দরকার হয়। তা সরকার দিয়ে থাকে। সরকার পরিবর্তন  হলে তারাও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি বলেন, একীভূতকরণের সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। অর্থনীতিকে সচল রাখতে হবে, ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী রাখতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যখন যেখানে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন, তা করবে।

 


 

আরও পড়ুন

×