ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ছে, হচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ছে, হচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান

.

 ওবায়দুল্লাহ রনি 

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫ | ০১:২২ | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৫ | ০৭:০৫

স্বাধীনভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে এর প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণে জাতীয় সংসদের অনুমতি লাগবে। আর্থিক খাত ও ব্যাংকিং বিষয়ে জ্ঞান রাখেন– এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত হবে। পর্ষদে সরকারি কোনো আমলা রাখা যাবে না। এ রকম বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর মাধ্যমে। জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যা অধ্যাদেশ বা আইন আকারে জারির লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। এর পর থেকে এ অধ্যাদেশের আলোকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন, গভর্নর-ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও নির্বাহী পরিচালক পদোন্নতি হবে। ব্যাংক খাত তদারকি, বৈদেশিক মুদ্রার অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। 

সরকারি সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে। খসড়াটি শিগগিরই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হবে। খসড়া প্রস্তুতের কাজ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক কর্মকর্তা সাকের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের অভাবেই ব্যাংক খাতে বড় জালিয়াতি হয়েছে বলে আলোচনা রয়েছে। সরকারি ব্যাংকে দ্বৈতশাসন নিয়েও নানা সমালোচনা রয়েছে। নতুন অধ্যাদেশ কার্যকর হলে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক পরিচালনার একক ক্ষমতা থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।

অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদমর্যাদা হবে মন্ত্রীদের সমান। পদক্রম অনুযায়ী যা চার নম্বরে। বর্তমানে গভর্নরের পদমর্যাদা ১৪ নম্বর ক্যাটেগরিতে, যা মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের নিচে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে সরকারের একটি বিভাগের মতো পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন খুব জরুরি। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গভর্নর নিয়োগ। কেননা, গভর্নর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সভাপতিত্ব করেন। ফলে গভর্নর পদে এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে যেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তা না করে শুধু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন হবে না। তিনি বলেন, একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে। কোন ধরনের ব্যক্তিকে গভর্নর পদের জন্য মনোনয়ন দেওয়া যায়, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা থাকতে হবে। সার্চ কমিটিতে কারা থাকবেন, তাও নির্ধারিত হতে হবে। সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের বাইরে প্রধানমন্ত্রী কাউকে গভর্নর নিয়োগ দিতে পারবেন না।

খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে আট সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকবে। যেখানে কোনো সরকারি কর্মকর্তা থাকবে না। গভর্নরের দেওয়া তালিকা থেকে সরকার পরিচালক নিয়োগ দেবে। পরিচালকদের মধ্যে গভর্নর মনোনীত দু’জন ডেপুটি গভর্নর থাকবেন। এ ছাড়া বাকি পরিচালক নিয়োগের জন্য গভর্নর একটি তালিকা দেবেন। অধিক সংখ্যক ব্যক্তির তালিকা এমনভাবে দিতে হবে যেন সরকার সেখান থেকে বাছাই করে পরিচালক নিয়োগ দিতে পারে। গভর্নরের দেওয়া তালিকার বাইরে কাউকে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। পরিচালক পদে যাদের নাম দেওয়া হবে, তাদের অবশ্যই অর্থনীতি, ব্যাংকিং, হিসাবরক্ষণ, অর্থ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং, বাণিজ্য, শিল্পঝুঁকি ব্যবস্থাপনা অথবা আইনের মতো ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ৯ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। সেখানে একজন ডেপুটি গভর্নর পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। এ ছাড়া অর্থ সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব পদাধিকারবলে পরিচালক। 

নিয়োগ ও অপসারণে সংসদের অনুমতি লাগবে
খসড়ায় বলা হয়েছে, মন্ত্রীর মর্যাদায় গভর্নর নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ এবং সংসদের অনুমোদনক্রমে উপযুক্ত ও যথাযথ মানদণ্ড বিবেচনা করে এ পদে নিয়োগ দিতে হবে। আর গভর্নরের সুপারিশ এবং সংসদের অনুমোদন নিয়ে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে কমপক্ষে চারজন ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দিতে হবে। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নররা নিয়োগের আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে শপথ নেবেন। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর উভয়ে ছয় বছরের জন্য পদে নিয়োগ পাবেন। একবারের জন্য তাদের পুনর্নিয়োগ দেওয়া যাবে। উভয় ক্ষেত্রে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ও আইন বিষয়ে অন্তত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে চলবে।

খসড়া অনুযায়ী চাইলেই গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং পরিচালকদের অপসারণ করা যাবে না। কেউ যদি নিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন করেন, আস্থা ভঙ্গ করেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থি কোনো কাজ করেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ এবং সংসদের অনুমোদন নিয়ে অপসারণ করতে পারবেন রাষ্ট্রপতি। এর আগে অবশ্যই তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে এবং শুনানি করতে হবে। অবশ্য গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নর রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করতে পারেন। পরিচালকরা সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র দিতে পারবেন।

পরিচালনা পর্ষদ 
বাংলাদেশ ব্যাংকে আট সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। পরিচালকদের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ তিন বছর। আর একবার তাদের পুনর্নিয়োগ দেওয়া যাবে। পরিচালনা পর্ষদ মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও তত্ত্বাবধান, আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং তদারকি মান প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মী নিয়োগ ও সুযোগ-সুবিধা, ব্যাংক তদারকিসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

ব্যাংকের কার্যক্রমের সামগ্রিক তত্ত্বাবধান এবং কৌশলগত দিকনির্দেশনার দায়িত্বভার ন্যস্ত থাকবে পর্ষদের ওপর। প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন রক্ষা এবং স্বাধীন মর্যাদা আরও শক্তিশালী করা হবে পর্ষদের অন্যতম কাজ। প্রতিবছর কমপক্ষে ছয়বার এবং প্রতি ত্রৈমাসিকে কমপক্ষে একবার পর্ষদ সভা আহ্বান করবেন গভর্নর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হবেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সে হিসেবে পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা করা আবশ্যক নয়– এ রকম বিষয়ে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। ব্যাংকের মূল কার্যাবলি, প্রশাসন এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিষয়ে গভর্নরকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি নির্বাহী উপদেষ্টা কমিটি থাকবে। কেবল মুদ্রানীতি কমিটি, নিরীক্ষা কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদের আওতাধীন বিষয় বাদ দিয়ে এই কমিটিতে বিভিন্ন আলোচনা হবে। কমিটিতে গভর্নর, সকল ডেপুটি গভর্নর এবং গভর্নর মনোনীত সিনিয়র নির্বাহী পরিচালকরা থাকবেন। সব সদস্য আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং মতামত দিলেও সিদ্ধান্ত নেবেন কেবল গভর্নর।

সমন্বয় পরিষদ
মুদ্রা ও বিনিময় হারের নীতি সমন্বয়ের জন্য একটি পরিষদ গঠন করতে হবে। সমন্বয় পরিষদ নামে যা পরিচিত হবে। এ পরিষদের চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন গভর্নর, বাণিজ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী। সদস্য সচিব হিসেবে থাকবেন অর্থ বিভাগের সচিব। এই পরিষদ সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমন্বয় বাড়ানো, রাজস্ব, মুদ্রা এবং বিনিময়হার নীতির মধ্যে সমন্বয়ে কাজ করবে। বাজেট চূড়ান্ত করার আগে বেসরকারি খাতের ঋণ চাহিদা, আর্থিক সম্প্রসারণ, মূল্যস্ফীতি এবং নিট বৈদেশিক সম্পদ বিবেচনা করে সরকারি খাতের ঋণ মূল্যায়নের জন্য সভা করবে। প্রতি তিন মাসে এ কমিটি অন্তত একবার সভা করবে।

বাধ্যতামূলক ব্যাংক রেজল্যুশনের ক্ষমতা
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫-এর অধীনে নিয়ন্ত্রক এবং তত্ত্বাবধানমূলক কাজের পাশাপাশি ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। এ অধ্যাদেশের আলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যাংক রেজল্যুশনের জন্য আলাদা একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংক তত্ত্বাবধানের কাঠামো বাস্তবায়ন, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং দ্রুত সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঝুঁকিভিত্তিক তদারকির আলোকে কোনো ব্যাংকের দুর্বলতা দেখা দিলে মূলধন ও প্রশাসনিক সংস্কারের মতো সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়ুন

×