ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

রাজস্ব ঘাটতি কমাতে ব্যাংক ও স্বয়ংক্রিয় লেনদেন বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

রাজস্ব ঘাটতি কমাতে ব্যাংক ও স্বয়ংক্রিয় লেনদেন বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২০ | ০৯:৫২ | আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০২০ | ১০:১৬

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে এগোচ্ছে না। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। অপরদিকে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে নিম্ন অগ্রাধিকারের প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ রেখেছে। এতে স্থানীয় বাজারে চাহিদা ও কাজের সুযোগ কমেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে প্রচলিত ব্যবস্থায় রাজস্ব আহরণ কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আহরণ ঠিক রাখার জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে তার ওপরের সকল লেনদেন ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যবস্থার আওতাভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে করের আওতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে, যা রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে দেবে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত জানুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও চাহিদা বদলে গেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। দীর্ঘ লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। কৃষি, শিল্প, সেবা সব খাতই গতি হারিয়েছে। প্রচলিত রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস উৎপাদন, বিপণন, আমদানি, রপ্তানি সবই বন্ধ ছিল, যার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের রাজস্ব আয়ে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কর রাজস্ব আদায় হয়েছে এক লাখ ৬৮ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। আর কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩১ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২ লাখ ২৪৮ কোটি টাকা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রকাশনায় রাজস্ব বোর্ডের সূত্রে জানানো হয়েছে, মোট রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। দুটোই সাময়িক হিসাব বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সরকার নির্ধারিত ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকার সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম। এমন অবস্থায় চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা আহরণ করা হবে।

এক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। জিডিপির আকার বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না, যে কারণে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৯ থেকে ১০ শতাংশ, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে কর জিডিপি অনুপাত ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার না হওয়ায় তা হচ্ছে না।

ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করেন, যথাযথভাবে পরোক্ষ কর অর্থাৎ ভ্যাট আদায়, একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপরের লেনদেনে অনলাইন ব্যবস্থা চালু বা ব্যাংকিং মাধ্যমে লেনদেন বাড়ানো, সরকারের সংস্থাগুলো যে ভ্যাট আদায় করে সেগুলো রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে সময়মত জমা, উন্নয়ন প্রকল্প ও অন্যান্য যেসব ক্ষেত্রে কর অব্যহতি রয়েছে সেগুলো বন্ধ করা এবং রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা গেলে কর জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ৫ শতাংশ বাড়বে। এক কথায় রাজস্ব খাতের সংস্কার কর্মসূচিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। 

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, কী কী কাজ করলে রাজস্ব আহরণ বাড়বে তা ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমত করের আওতা বাড়ালে অর্থাৎ যেখান থেকে যে পরিমাণ কর আহরিত হওয়ার কথা এবং যাদের কর দেওয়ার কথা তাদের করের আওতায় আনতে কর-জিডিপি অনুপাত আরও ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে। এজন্য অনলাইন ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করতে হবে। এতে এনবিআরের জনবল ঘাটতির সমস্যা কমে যাবে। তবে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও এনবিআরের কর্মীরা তা চান না। এছাড়া ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে বা ভ্যাটের আওতার বাইরে রয়েছে তাদের থেকে কর আদায় নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সরকার যে সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রকল্পে কর অব্যহতি দিচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। এতে রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি অপচয়, অনিয়ম কমে স্বচ্ছতা বাড়বে। যদিও কেউ কেউ বলেন সরকারের প্রকল্পে কর নেওয়ার অর্থ এক পকেটের টাকা আরেক পকেটে রাখা। তা হয়ত টাকার বেলায় ঠিক, কিন্তু এই কর নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে একটি পণ্য কত দামে কেনা হচ্ছে, কী পণ্য কেনা হচ্ছে তার চেক অ্যান্ড ব্যালান্স হয়। যখন কর অব্যহতি থাকে তখন এক টাকার পণ্য ৫ টাকায় কিনলেও দেখার কেউ থাকে না। এতে আর্থিক শৃংখলা আসার পাশাপাশি কর-জিডিপি অনুপাত বেড়ে যাবে প্রায় এক শতাংশ। এছাড়া সরকারের সেবা দপ্তরগুলো যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, বিটিআরসি, বিআরটিএ ইত্যাদি জনগণ থেকে ভ্যাটসহ অন্যান যেসব কর সংগ্রহ করে রাজস্ব বোর্ডকে দিচ্ছে না, সেগুলো দ্রুত জমার ব্যবস্থা করতে হবে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য সংস্কারের বিকল্প নেই। অনিয়ম বন্ধ করে করের আওতা বাড়ানো গেলে সহজেই রাজস্ব আহরণ বাড়বে। এজন্য অটোমেশন বাড়াতে হবে।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, দেশে অনেকেই আছেন যারা আয়কর বিবরণী দাখিল করেন না। অথচ তাদের জীবনযাপন ব্যয় কিন্তু করযোগ্য আয়ের চেয়ে বেশি। ফলে একটা নির্দিষ্ট সীমার বেশি অংকের লেনদেন যদি অনলাইন বা ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আনা যায়, তাহলে সরকার দেখতে পারবে কে কোথায় কী কাজে কতটা ব্যয় করছে। তখন যারা আয়কর বিবরণী দিচ্ছেন না, তাদের ব্যয় ধরে বলা যে, আপনার এ ধরনের ব্যয় করার সামর্থ থাকার পরেও কেন আয়কর বিবরণী দিচ্ছেন না। এতে স্বচ্ছতা বাড়ার পাশাপাশি করের আওতা বাড়বে। ভ্যাট সংগ্রহের বেলায়ও একই ধরনের উদ্যোগ থাকা উচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ১৭ কোটি মানুষের বাজার রয়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে। আবার সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তিও অনেক বেড়েছে। এই বিশাল বাজার অনুযায়ী যে পরিমাণ পরোক্ষ কর আহরণ হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। অন্যদিকে দেশে মাত্র ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ কর দিচ্ছে। কিন্তু কর দেওয়ার সামর্থ মানুষের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। এজন্য কাউকে হয়রানি না করে ন্যায়সঙ্গতভাবে করের আওতায় আনার অন্যতম উপায় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা। কিছু পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা। এসব ঠিকমত করা হলে সরকার রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য নিয়েছে তার চেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ সম্ভব। দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে। বর্তমানে ২১০০ জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে। ১০ কোটির বেশি মোবাইল সিম কার্যকর দেশে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ব্যাংকিং খাতের অনলাইন সুবিধা, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং সবই বাড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করা যাচ্ছে। ফলে কর ব্যবস্থার সংস্কার বর্তমানে বেশ সহজ।

আরও পড়ুন

×