আদালতের নির্দেশ অমান্য করে লেনদেন

ছবি: ফাইল
ওবায়দুল্লাহ রনি
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ | ১৫:১৭
অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন ও তার স্বার্থসংশ্নিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ নির্দেশনা পাঠানো হয় সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। অথচ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের মালিকানাধীন গ্রেট ওয়ালস ল্যান্ড প্রোপার্টির নামে অ্যাকাউন্ট খুলে তাতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেনের সুযোগ দিয়েছে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের বনানী শাখা। ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম হোসেন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বিএফআইইউর এক তদন্তে এমন তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।
অনিয়মকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমসহ পিপলস লিজিংয়ের সাবেক ৪৬ পরিচালক ও ১৭ কর্মকর্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। এরপর ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে তা সাউথ বাংলা ব্যাংকের এমডির কাছে পাঠানো হয়। এমডি ওই দিনই এ নির্দেশনা সব শাখা প্রধানের কাছে পাঠিয়ে দেন। এর আগে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমসহ পিপলসের সাবেক ৮ পরিচালক ও তিন কর্মকর্তার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা সব ব্যাংকে দেওয়া হয়। ওই সময় তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরেও নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।
বিএফআইইউর তদন্তে উঠে এসেছে, আদালতের নির্দেশ অমান্য করে গত বছরের ২৭ জানুয়ারি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের বনানী শাখায় ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের মালিকানাধীন গ্রেট ওয়ালস ল্যান্ড প্রোপার্টির নামে একটি ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। বনানী শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক ও ব্যাংকের ডিএমডি আলতাফ হোসেন ভূঁইয়া ব্যাংকিং নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে হিসাব খোলা ও পরিচালনার সুযোগ করে দেন। আবাসন খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা এ হিসাবে গত ২৭ জানুয়ারি থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বড় অঙ্কের লেনদেন হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর অ্যাকাউন্টটিতে জমার পরিমাণ ছিল এক কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান গত সোমবার সমকালকে বলেন, পিপলস লিজিং-সংশ্নিষ্টদের অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধের নির্দেশনা ছিল উচ্চ আদালতের। আদালতের নির্দেশে বিএফআইইউ এ সংক্রান্ত আদেশ সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠায়। এরপরও কোনো ব্যাংক এ ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট খোলা বা লেনদেনের সুযোগ দিলে তা আদালত অবমাননা। একই সঙ্গে বিএফআইইউর নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বিএফআইইউর তদন্তের ঘটনাটি উদ্ঘাটনের পর এসবিএসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় আলতাফ হোসেনকে গুলশান শাখায় বদলি করেছে। একই সঙ্গে তার ব্যাখ্যা তলব করে গত ২২ ডিসেম্বর চিঠি দেয় ব্যাংক। শাখা ব্যবস্থাপককে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, গ্রেট ওয়ালস ল্যান্ড প্রোপার্টির অ্যাকাউন্ট পরিচালনার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে বিএফআইইউর নির্দেশনারও লঙ্ঘন হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২৩ এর (৬) ধারা অনুযায়ী এটি জরিমানাযোগ্য অপরাধ। নির্দেশ অমান্য করে অ্যাকাউন্ট খোলা ও পরিচালনার বিষয়ে গত ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে আলতাফ হোসেনের লিখিত বক্তব্য চাওয়া হয়। তবে তিনি সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। এরপরও গত ৪ জানুয়ারি থেকে তিনি গুলশান শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন।
জানতে চাইলে বনানী শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক আলতাফ হোসেন ভূঁঁইয়া সমকালের কাছে দাবি করেন, বিধিসম্মতভাবেই গ্রেট ওয়ালস ল্যান্ড প্রোপার্টির অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর তা ফ্রিজ করা হয়েছে। আদালত তো গত বছরের ২৮ জানুয়ারি নির্দেশনা দিয়েছিল, ১২ ফেব্রুয়ারি যা শাখায় পাঠানো হয়েছিল। অথচ এর প্রায় ১১ মাস পর গত ১৪ ডিসেম্বর বিএফআইইউর পরিদর্শনে বিষয়টি ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত এই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা বিধিসম্মত কিনা এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট ফ্রিদ্ধজের আদেশ দেওয়ার পর তার নামে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা বা পরিচালনার সুযোগ নেই। আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘনের শাস্তি কী হবে তা আদালত ঠিক করবেন। তবে বিএফআইইউর নির্দেশনা অমান্য করে কোনো ব্যাংক অবরুদ্ধ হিসাবে লেনদেনের সুযোগ দিলে কমপক্ষে ওই হিসাবে স্থিতি সমপরিমাণ জরিমানা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্থিতির দ্বিগুণ জরিমানা করা যায়। এ জন্য কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। তা শেষ হলেই জরিমানা আরোপের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে পিপলস লিজিং থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণের অর্থ বের করে নেওয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ধুঁকতে থাকা পিপলস লিজিং ২০১৯ সালের জুলাই থেকে আদালতের নির্দেশে অবসায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর আগে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালে পাঁচ পরিচালককে অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর অপসারণের আগেই তখন পিপলস লিজিং থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক।
- বিষয় :
- আদালতের নির্দেশ
- লেনদেন
- টাকা লেনদেন
- পিপলস লিজিং