ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সমকালীন প্রসঙ্গ

বাজারের তাপে পুড়ছে মানুষ

বাজারের তাপে পুড়ছে মানুষ

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষুষ্ণ

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২২ | ১২:০০

করোনার দাপট এখন কমেছে বটে, কিন্তু বাজারে তাপ ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে এমন দৃশ্যও চোখে পড়েছে, পরিচিতজনের সামনে একে অন্যকে বাজারে গিয়ে কেনাকাটায় এড়িয়ে যেতে। কারণ, অনেকটাই চক্ষুলজ্জা এবং ব্যয় সংকোচন। অধিকাংশ নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, যে কোনো উপলক্ষে বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি আরও বেড়ে যায়।
রমজান মাস প্রায় সমাগত। প্রতিবারই দেখা যায়, রমজান উপলক্ষে ভোক্তার পকেট কেটে অসাধু ব্যবসায়ীদের উদরপূর্তির পাঁয়তারা। সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রশাসনের তরফে এমন পরিস্থিতিতে 'কঠোর হুঁশিয়ারি' কিংবা অতি মুনাফার ব্যাপারে 'সতর্কবার্তা' উচ্চারিত হলেও এসব কোনো কিছুই যে সুযোগসন্ধানীদের কাছে তেমনভাবে আমলযোগ্য হয় না- এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষের আছে বিস্তর। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলার ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করল, এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে? সংবাদমাধ্যমেই জানা গেছে, ছোলা আমদানিতে কোনো শুল্ক্ককর আগে থেকেই ছিল না। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, চিনির ওপর নতুন করে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। ভোজ্যতেলের ওপর থেকে ভ্যাট কিংবা মূসক প্রত্যাহার করলে সুফল পাওয়ার কথা থাকলেও অর্থমন্ত্রী যে প্রক্রিয়ায় ভ্যাট ছাড়ের কথা বলেছেন, তাতে ব্যয় আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলো। অর্থমন্ত্রী বলেছেন 'জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখার জন্য ভ্যাট তুলে নিয়েছি। সারাদেশে টিসিবির মাধ্যমে জনগণকে স্বল্পমূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হবে।' এমন বক্তব্য আশ্বস্ত হওয়ার বিষয় হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সক্ষমতা, পরিসর, জনবল ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন মানুষমাত্রেরই জানা। একসময়ের শক্তিশালী এই সংস্থাটির বর্তমান চিত্র নানা কারণেই বিবর্ণ। তাদের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি ক্ষুদ্র পরিসরে পরিচালিত কর্মকাণ্ডও প্রশ্নমুক্ত নয়। টিসিবি যে পরিসরে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা যেন সিন্ধুর মধ্যে বিন্দুর মতো। নানা দিকে পিছিয়ে থাকা এই সংস্থাটির মাধ্যমে সরকার ভোক্তার চাহিদার নিরিখে কতটা কী করতে পারবে- এ নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নিষ্প্রয়োজন। ১২ মার্চ সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খুলনা নগরী ও জেলায় কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য বিক্রি নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে, তা খণ্ডিত দৃষ্টান্ত হলেও অখণ্ড চিত্র কি এর চেয়ে উজ্জ্বল? তা ছাড়া অর্থমন্ত্রী ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট ছাড়ের যে ঘোষণা দিয়েছেন, এর যে সুফল মিলবে না তা-ও অস্পষ্ট নয়। কারণ, আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট বজায় রেখে সরবরাহ পর্যায়ে রেয়াত নেওয়ার সুযোগ প্রকৃতপক্ষে কতটা থাকবে? যদি এই হয় বাস্তবতা, তাহলে মন্ত্রীর ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণার মানেই বা কী? সংবাদমাধ্যমেই জানা গেছে, দেশের সাতটি ভোজ্যতেল রিফাইনারি তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রমজানসহ দেড় মাসের চাহিদার তুলনায় ভোজ্যতেলের মজুত অনেক বেশি আছে।
বাজারে 'সিন্ডিকেট' শব্দটি বহুল উচ্চারিত। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও অতীতে বহুবার বলেছেন, 'সিন্ডিকেট'-এর অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু দুঃখজনক ও বিস্ময়কর হলেও সত্য, 'সিন্ডিকেট'-এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ইনি, উপরন্তু এর দাপট আরও বেড়েছে। সম্প্রতি হঠাৎ ভোজ্যতেল বাজার থেকে 'নাই' হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফে অভিযান চালিয়েও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা বন্ধ করা যায়নি। তেল নিয়ে তেলেসমাতি চলছেই। ১০ মার্চ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দুটি ভোজ্যতেলের কারখানায় পরিদর্শনে গিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অসংগতি দেখতে পেয়েছেন। তাতেও প্রতীয়মান হয়, সরকারের 'কঠোর বার্তা' তারা থোড়াই আমলে নেন। এ তো শুধু একটি এলাকার দুটি কারখানার চিত্র। চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য কারখানাগুলোতেও শক্তিমানদের অপপ্রক্রিয়া থেমে নেই- এমন অভিযোগও উঠেছে। অসাধুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর হটলাইন ১৬১২১ নম্বর চালু করেছে। তাতেও বোঝা যায়, তেল নিয়ে কী ভয়াবহ তেলেসমাতি চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের শক্তির উৎস কোথায়। একই সঙ্গে প্রশ্ন, ক'জন মানুষের পক্ষে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা সম্ভব।
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে বিএনপিপন্থি সিন্ডিকেটও দায়ী।' ঘুরেফিরে 'সিন্ডিকেট'-এর অস্তিত্ব আবারও স্বীকার করছেন আরও এক মন্ত্রী, তবে তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। বর্তমান সাংগঠনিক শক্তির নিরিখে বিএনপিপন্থি কার এতটা সাহস কিংবা জোর আছে যে ভোক্তার পকেট কেটে নিজের আখের গোছাবেন? সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, গত এক সপ্তাহে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আটা, পেঁয়াজসহ ১০টি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চাল নিয়ে চালবাজি তো পুরোনো বিষয়। যে মোটা চাল গরিবের বেঁচে থাকার অবলম্বন, এর দাম তুলনামূলক হারে আরও বেশি! 'সিন্ডিকেট'-এর হোতারা কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী? আমদানি করতে হয় না কিংবা বিশ্ববাজারে দাম বাড়েনি- এমন পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী কেন? বাজারে টানা দীর্ঘমেয়াদে যে তুঘলকি কাণ্ড চলছে, খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে কিংবা বিনা কারণে এর প্রতিকারে সরকার কি দৃষ্টান্তযোগ্য কোনো দৃষ্টান্ত রাখতে পেরেছে? চাহিদার নিরিখে একেবারেই অপ্রতুল পণ্য নিয়ে টিসিবির ট্রাকগুলোর পেছনে মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়ার চিত্রও সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে এখন লাইন দিচ্ছেন অনেক মধ্যবিত্তও।
১১ মার্চ 'দ্রব্যমূল্যের পালে রোজার হাওয়া' শিরোনামে সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতেও যেন ফের প্রতীয়মান হয়- বাজারের নাটাই অসাধুদের হাতেই। নানা মহল থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে কঠোরভাবে বাজার তদারকির। কিন্তু তদারকির নামে আমরা যে কার্যক্রম দেখে আসছি, তাতে যে অতি মুনাফার লোভ অসাধু ব্যবসায়ীদের টুটকা দাওয়াইয়ে সংবরণ করানো যাবে না, তা-ও স্পষ্ট। আমাদের বাজারে অর্থনীতির ধ্রুপদি নিয়ম কতটা অচল, এরও নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নিষ্প্রয়োজন। মুক্তবাজার অর্থনীতির মানে কি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বা তদারকির সুতা ছিঁড়ে যাওয়া? সিন্ডিকেটের কারসাজি ক্রমেই বেড়ে চলেছে কীভাবে? মুক্তবাজার অর্থনীতির সুযোগে অসাধুরা স্বেচ্ছাচারিতা চালাবে আর সরকারের দায়িত্বশীলরা লোক দেখানো কর্মকাণ্ড কিংবা বাক্যবাণেই সব দায় সারবেন, তা তো হতে পারে না। সরকারের দায়িত্বশীলদের ঘোষণা কিংবা সিদ্ধান্ত কেন আরও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে? এই 'কেন'র উত্তর দেওয়ার দায় তো সরকারেরই। ভুলে যাওয়া অনুচিত, মানুষকে অচেতন করে রাখা এখন এত সহজ নয়।
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষুষ্ণ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]

আরও পড়ুন

×