অন্যদৃষ্টি
দায়িত্বহীনতার ছায়ায় বধ্যভূমি

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষুষ্ণ
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২২ | ১৪:৫০
ভুলে যাওয়া কিংবা ভুলে থাকা মানুষের স্বভাবের অন্তর্গত প্রবণতা। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে, যা ওই প্রবণতাজাত নয়; বরং বলা যায়, এটা স্পষ্টতই উদাসীনতা আর অবহেলা; যা অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, বিস্ময়কর বিষয়। ২৩ মার্চ 'দেশে কত বধ্যভূমি, জানে না কেউ' শিরোনামে সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি যেন এরই সাক্ষ্যবহ। অবহেলায় আমাদের ত্যাগ ও গৌরবের অনন্য স্মারক বধ্যভূমি হারিয়ে যাওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন এর মধ্যে সংবাদমাধ্যমে কম উঠে আসেনি। উল্লেখ্য, বাঙালির অক্ষয় অধ্যায় একাত্তর পর্বে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করতে অনেক স্মৃতিস্তম্ভ দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে এবং এর অধিকাংশই হয়েছে স্থানীয় উদ্যোগে। কিন্তু একই সঙ্গে এও মর্মবেদনার বিষয়, অধিকাংশ স্মৃতিস্তম্ভের অবস্থাই করুণ। স্মৃতির এই মিনারগুলো কিংবা গণকবর, বধ্যভূমি বা ইতিহাসকে ধারণ করায় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে ফিরে ফিরে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয় বটে, কিন্তু বাস্তবে এর কার্যকর প্রতিফলন কতটা দৃশ্যমান, এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে বধ্যভূমি হারিয়ে যাওয়া কিংবা অনেক ক্ষেত্রে অচিহ্নিত থাকার খণ্ডিত দৃষ্টান্তের মধ্যেই। আর যদি অখণ্ড দৃষ্টান্তের প্রসঙ্গ আসে তাহলেও এ কথাই বলা যায়, এসব ব্যাপারে সরকারের তরফে দৃশ্যত উদ্যোগ-আয়োজনের ঘাটতি নেই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কার্যত বাস্তবায়ন চিত্র দৃশ্যমান নয়।
আমরা স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী সাড়ম্বরে উদযাপন করেছি গতবার। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫১ বছরে পা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পর্ব আমাদের জাতীয় জীবনের শুধু অক্ষয় অধ্যায়ই নয়; বিশ্ব ইতিহাসেও বিশেষ করে তা স্থান করে নিয়েছে। এরই দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, যা জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত 'বিশ্বঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল' হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। কিন্তু আমরা আমাদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে কতটা সজাগ? যাদের আত্মত্যাগে অর্জিত এই পতাকা-মানচিত্র তাদের স্মৃতি সংরক্ষণে দায়িত্বশীলদের অবহেলা-উদাসীনতার ছায়া আর কত বিস্তৃত হবে? স্মৃতির মিনার, মুক্তিযুদ্ধের অনন্য স্মারক বধ্যভূমি কিংবা অন্য স্মৃতি সংরক্ষণে কার্যকর কতটা কী করেছে সরকার- এমন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সরকারকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কেন হতে হয়- এই আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি।
সমকালের ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, বধ্যভূমির সংখ্যা কত, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিবেশিত তথ্য থেকে জানা যায়নি! মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের চিহ্নিত বধ্যভূমির সংখ্যা হাজারের বেশি হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য রয়েছে ২৮০টি বধ্যভূমির! সেগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রকল্প কয়েক বছর আগে নেওয়া হলেও দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে এবং বিস্ময়কর ও চরম ক্ষোভের কারণ, সিংহভাগ বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরুই হয়নি! একদিকে বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণে সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা, অন্যদিকে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের এই হাল সংগতই প্রশ্ন দাঁড় করায়- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন-ধারণের অঙ্গীকার-প্রত্যয় কি তাহলে উচ্চারণসর্বস্ব? আমরা জানি, সব বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ সম্ভব নয়, কিন্তু স্থান চিহ্নিত করে সংরক্ষণ-উদ্যোগের এত বেহাল দশা কেন?
বধ্যভূমি ও বিস্মরণের ইতিহাস অনেকটাই উঠে এসেছে অভিনেতা ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা কাওসার চৌধুরীর সরকারি অনুদানে নির্মিত 'বধ্যভূমিতে একদিন' শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রে। জানা গেছে, জনপদ সম্প্রসারণের কারণে অনেক বধ্যভূমি চাপা পড়ে গেছে, দখল হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- বাংলাদেশের জন্মক্ষণের 'প্রসব বেদনা'র ইতিহাসের অংশ চলমান উন্নয়নযজ্ঞে প্রাধান্য পেল না কেন? মুক্তিপাগল জনতার রক্তে স্নাত এই বাংলাদেশে বাঙালির আত্মত্যাগের পবিত্র চিহ্নগুলো উদ্যোগহীনতা-অবহেলা আর উদাসীনতায় হারিয়ে যেতেই থাকবে? নীতিনির্ধারকরা মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জেনে প্রজন্মকে চেতনাসমৃদ্ধ হওয়ার কথা অহরহ বলেন। কিন্তু, তারা ওই মহান অধ্যায়ের স্মারক সংরক্ষণে কতটা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পেরেছেন, যা ইতিহাস আত্মস্থ করার জন্য অন্যতম অনুষঙ্গ? আমরা জানি, শুধু স্থলভাগই নয়, বাংলাদেশের অনেক নদনদীর বক্ষও বধ্যভূমি। রক্তস্নাত যে দেশটি পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি-কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে উন্নয়নের ধারায় ফিরে এসেছে- এ কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, সে দেশে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অন্যতম স্মারক এত অবহেলার ছায়ায় কেন? এই গ্লানি ও অনেক প্রশ্নের ভার এ প্রশ্নেরও জন্ম দেয়- প্রকৃতই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মর্মে নিতে পেরেছি? আমরা চাই, অবিলম্বে সব বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি স্মৃতির মিনারগুলোর যত্ন ও সংস্কার উন্নয়নযজ্ঞের বিশেষ অংশ হোক।
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষুষ্ণ: সাংবাদিক ও লেখক