তথ্যপ্রযুক্তি
অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ বিনির্মাণ

অজিত কুমার সরকার
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২২ | ১৪:৪০
ডিজিটাল যুগের আলোচিত একটি বিষয় অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ বিনির্মাণ। যাদের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি-কৌশলই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন তাদের জন্য ডিজিটাল বিপ্লব এমন একটি সমাজ বিনির্মাণের পথচলাকে সহজ করেছে। বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রাগ্রসরমান প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবা সামাজিক বৈষম্য দূর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ায় অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা তৈরি করছে। স্মর্তব্য যে, আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি-কৌশলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যার ভিত রচনা করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালে সংবিধানে তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও সমাজ বিনির্মাণ বা সমতাভিত্তিক অংশীদারিমূলক সমাজ কাঠামো গড়ে তোলার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজের পিছিয়ে পড়া, ছিন্নমূল অসহায় ও দরিদ্র মানুষের উন্নয়নে আশ্রয়ণ, ঘরে ফেরা, একটি বাড়ি একটি খামারের মতো প্রকল্পসহ বহু সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাস্তবায়ন করছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো একটি আধুনিক কর্মসূচির বাস্তবায়নেও এই নীতি-কৌশলের প্রয়োগ সম্ভব, যা শুধু নগর ও শহরের ডিজিটাল বৈষম্য দূর করবে না, অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জনেও সহায়তা করবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি-কৌশল প্রয়োগের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া, অসহায়, প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসা এবং তাদের জীবন-মানের উন্নয়ন করা। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট বিস্ময়কর আবিস্কারের পথ ধরে ডিজিটাল বিপ্লবে নতুন মাত্রা যোগ হয়। তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশগুলো প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহার করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়। যদিও ওই সব দেশ আজও ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থসামাজিক বাধা অতিক্রমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। কারণ গ্রামের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নেটওয়ার্কে আনা এবং প্রতিবন্ধী, পিছিয়ে পড়া অসহায় ও দরিদ্র মানুষের জন্য তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল শিক্ষাদান ও দক্ষতা উন্নয়ন দুরূহ একটি কাজ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আইসিটি ব্যবহারে সক্ষমতা বাড়ানো ও প্রযুক্তিতে অভিযোজন; দ্বিতীয়ত, আর্থিকসহ বিভিন্ন অনলাইন সেবা, শিক্ষা ও জ্ঞানের জগতে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা; তৃতীয়ত, আইসিটিভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন। আমাদের দেশেও ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থসামাজিক বাধা অতিক্রমের বিরাট চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। তবে আমাদের সরকার বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন আছে বলে মনে হয়। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং 'কাউকেই পেছনে রাখা যাবে না'- জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর এমন অঙ্গীকার বাস্তবায়নেও সরকার আন্তরিক। যে কারণে ১৩ বছর আগে নগর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য দূর এবং মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয় গ্রাম থেকে। প্রতিষ্ঠা করা হয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। এরই ধারাবাহিকতায় জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে 'আমার গ্রাম, আমার শহর', দুর্গম এলাকার ৬১৭ ইউনিয়নে উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিতে 'কানেক্টিং বাংলাদেশ' 'ডিজিটাল আইল্যান্ড', 'হাওর অ্যান্ড বিল', 'ডিজিটাল ভিলেজ' প্রতিষ্ঠার মতো প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া 'তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার' প্রকল্পের আওতায় প্রতিবন্ধীদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। দেশের বড় ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম মুক্তপাঠে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্যও শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তিভোগীদের ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট তৈরি করে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতা দেওয়ার উদ্যোগগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ার জন্যই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আলোচ্য উদ্যোগগুলোর অধিকাংশের বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ২০১৮ সালের জানুয়ারির প্রতিবেদন থেকে এ ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম। সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে ভারত (৬২), পাকিস্তান (৫২), শ্রীলঙ্কা (৪০)। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের এই শক্তিশালী অবস্থানের কারণ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতি-কৌশলের প্রয়োগ। ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে যথার্থভাবেই মোবাইল ব্যাংকিংসেবার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় আর্থসামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে আর্থিক সেবায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি রীতিমতো বিস্ময়কর। ব্যাংকিংসেবাবহির্ভূত প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ, যাদের অধিকাংশই গ্রামের তাদের ব্যাংকিংসেবার অন্তর্ভুক্ত করেছে মেবাইল ব্যাংকিং। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ১০ কোটি নিবন্ধিত গ্রাহক ২০২১ সালের এপ্রিলে লেনদেন করে ৬৩ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। ডিজিটাল সেবায় মানুষের অন্তর্ভুক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ প্রকাশিত এটুআইর প্রকাশনা 'দ্য এটুআই জার্নি মেকিং ডিজিটাল ইনোভেশন ওয়ার্ক ফর দ্য পুওর' এর তথ্য থেকে। এতে বলা হয়, ১০ বছরে মানুষকে অনলাইনে ৪০৯ কোটি সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ওয়ার্ড ইত্যাদি মিলে ৮২৬০টি ডিজিটাল সেন্টার থেকেই দেওয়া হয় ৬৮ কোটি সেবা। প্রতি মাসে এসব সেন্টার থেকে সেবা দেওয়া হচ্ছে ৬০ লাখ। ১৮ কোটির বেশি মোবাইল সিমের ব্যবহার, ১৩ কোটি মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহার প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ও অভিযোজিত হওয়ার বড় প্রমাণ।
কিন্তু ১৩ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য অর্জিত হলেও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলায় সরকারকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। এ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী- এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি ৭ এপ্রিল ২০২২ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের তৃতীয় সভা সম্পর্কিত একটি সংবাদ থেকে। ওই সভায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরবর্তী ধাপে ২০৪১ সালে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনাসংবলিত একটি রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। কী আছে 'স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১' শীর্ষক রূপরেখায় তা জানার চেষ্টা করি। দেখা গেল, অনেক আধুনিক ও উন্নত দেশের মতোই অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এ রূপরেখায়। সমাজ, শিক্ষা, সরকার এবং ব্যবসা- এই চার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা হবে। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ বিশেষ করে প্রতিবন্ধী, থার্ড জেন্ডার, ট্রান্সজেন্ডার, যৌন কর্মীদের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির জন্য ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভালনারেবল এক্সসেপশন (ডিইভিই) নামে প্রকল্প গ্রহণেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আরও আলোচনা হয় সব মানুষের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিতে ব্লেন্ডেড শিক্ষা চালু, ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে ব্যবসার সুযোগ এবং সরকারের সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম করে তোলার ওপর।
সংবিধানে 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' শীর্ষক অধ্যায়ের ১৫ অনুচ্ছেদের 'ঘ'-এ বলা হয়, 'সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতাহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।' বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ডিজিটাল বিপ্লবের প্রযুক্তি ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরের দেশগুলোতে ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। ফলে তখন অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ বিনির্মাণের আবশ্যকতা আজকের মতো এতটা জরুরি হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু সময়ের পথপরিক্রমায় নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নানা উদ্ভাবনী ও সমাধানের মাধ্যমে বিশ্বের দেশগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ বিনির্মাণ এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করছে। বাংলাদেশও এ সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ বিনির্মাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে 'স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১' পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যা আমাদের আশাবাদী করছে।
অজিত কুমার সরকার: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
- বিষয় :
- তথ্যপ্রযুক্তি
- অজিত কুমার সরকার
- ডব্লিউইএফ