দিবস
চা শিল্প ও শ্রমিকের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু

মো. আশ্রাফুল করিম
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২২ | ১২:০০
হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট এবং সুনামগঞ্জ- এই চার জেলার সমন্বয়ে বৃহত্তর সিলেট বিভাগ গঠিত। সিলেট শহরের উপকণ্ঠে ১৮৫৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা আবাদ প্রকল্প 'মালনিছড়া চা বাগান' প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, প্রায় একই সময়ে ভারতের আসামেও প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। চা গাছ বৃদ্ধিতে আরণ্যক পরিবেশ প্রয়োজন। এরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে বৃহত্তর সিলেটে চা চাষের সূচনা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রায় ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫টি চা বাগান নিয়ে বৃহত্তর সিলেট গড়ে উঠেছে।
চা বাগানে বসবাসরত প্রায় সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর চা শ্রমিকদের আদি আবাসস্থল ভারতের আসাম, বিহার, ওডিশা, মাদ্রাজ, পশ্চিমবঙ্গ, গুয়াহাটি, ছোটনাগপুর, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে। প্রায় ১৭০ বছর ধরে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা শতাধিক এবং জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। চা শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ করে চা চাষ ও এর উৎপাদন বৃদ্ধি, চায়ের গুণগতমান রক্ষা, বিদেশে চা রপ্তানি বৃদ্ধিতে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা, চা ব্যবসায় জড়িতদের প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ইস্যু ও সময়মতো নবায়নের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয়ে অফিসিয়াল সিদ্ধান্ত ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে পাকিস্তান টি অ্যাক্ট ১৯৫০-এর আলোকে 'পাকিস্তান টি বোর্ড' গঠন করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পমন্ত্রী এস এম সলিমকে পাকিস্তান টি বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তান টি বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন পাকিস্তান টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে যোগদান করার ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে ২০২১ সাল থেকে প্রতি বছর ৪ জুন জাতীয় চা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। ২০২১ সালের চা দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল 'মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, চা শিল্পের প্রসার'। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান টি বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী চা শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অবদান হলো- চা শ্রমিকদের স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ। এ অবদানের কথা চা শ্রমিকরা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। এ ছাড়া তিনি চা ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উচ্চফলনশীল বীজ উদ্ভাবনের সক্ষমতা অর্জনের পদক্ষেপ গ্রহণ, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মালিকানাবিহীন ও পরিত্যক্ত চা বাগানগুলোর পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। পাশাপাশি চা গবেষণা স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউটে রূপান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং চা শ্রমিকদের বিনামূল্যে বাসস্থানের ব্যবস্থা, রেশন, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এর ধারাবাহিকতা আর রক্ষিত হয়নি।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। তাঁরাও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৬০৩ জন চা শ্রমিক শহীদ হন, আহত হন অনেকেই এবং অনেক নারী চা শ্রমিক পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
দেশের অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা সত্ত্বেও বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে যুগ যুগ ধরে বসবাসরত অবহেলিত চা শ্রমিকদের কল্যাণার্থে বঙ্গবন্ধুর পর তেমন কোনো বৈপ্লবিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে যেসব বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, এর সফল বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্ন সার্থক করা হোক।
ড. মো. আশ্রাফুল করিম: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
[email protected]
- বিষয় :
- দিবস
- মো. আশ্রাফুল করিম
- চা শিল্প