প্রতিক্রিয়া
কমরেড ফরহাদ সম্পর্কে রনোর মন্তব্য দুঃখজনক

রুস্তম আলী খোকন
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০
গত ২৯ আগস্ট তাঁর ৮০তম জন্মদিনে দৈনিক সমকাল হায়দার আকবর খান রনোর একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে। সেখানে হতাশার বাণী এসেছে এই বর্ষীয়ান নেতার মুখ থেকে। বলেছেন, যে আশা নিয়ে সংগ্রামে এসেছিলেন, তা পূরণ হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টিকেই রাজনৈতিক জীবনের প্রাপ্তি হিসেবে দেখছেন। কিন্তু বাংলাদেশ অর্জনে হায়দার আকবর খান রনোদের ভূমিকা কি গৌরবোজ্জ্বল বলা যায়? মুক্তিযুদ্ধ করলেও তাঁরা ছিলেন বিভ্রান্ত। তাঁদের ভূমিকা ছিল অস্পষ্ট। আজ যে অর্জন নিয়ে জীবনসায়াহ্নে গর্বিত হচ্ছেন; সেই অর্জনের জন্য কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদই বিপ্লবীদের হয়ে কাজ করেছেন। সমকাল তাঁর যে সাক্ষাৎকার ছেপেছে, তাতে তিনি কাজী জাফর আহমদকে বিপ্লবী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, আর কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদকে বলেছেন অবিপ্লবী। কিন্তু দল বদল করে, নীতি পরিবর্তন করে, স্বৈরাচারের পদলেহন করে প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ ও রাষ্ট্র্রধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা কাজী জাফর কেমন করে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের চেয়ে অধিক বিপ্লবী হন, তা বোধগম্য নয়! কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ যখন ২০০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন; কাজী জাফর আহমদ তখন স্বৈরাচারী এরশাদের মায়ের মৃত্যুতে কান্নাকাটি করছেন। জেনারেল এরশাদকে নিয়ে টঙ্গী আর আদমজীতে করছেন জনসভা।
কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে হায়দার আকবর খান রনোর মূল অভিযোগ দুটি। একটি কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ছাত্র ইউনিয়নকে বড় সংগঠনে পরিণত করলেও শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর কোনো কাজ ছিল না। দ্বিতীয়ত, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের হাতে গড়া কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ সদস্য ১৯৯৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন। এ দুটি কারণে হায়দার আকবর খান রনোর ধারণা হয়েছে- কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ অবিপ্লবী পথে হেঁটেছেন। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নকে বৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত করেছিলেন। সেটি ছিল বাংলাদেশে বিপ্লবী সৃষ্টির কারখানা। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক, কাজী আকরাম গ্রামগঞ্জের পথে পথে হেঁটেছেন। ঘুমিয়েছেন ক্ষেতমজুরের ভাঙা ঘরে।
তাজুল ইসলাম গিয়েছেন আদমজীতে। এক সময় জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের মূল সংগঠন হয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র। বাংলাদেশ কৃষক সমিতি লাল টুপি পরে রাঙিয়েছে ঢাকার রাজপথ। ১০ নভেম্বর ১৯৮৭, ঢাকা অবরোধে চারদিকে শেখ হাসিনার লাল পতাকা হাতে সহিদুল্লাহ চৌধুরী নামিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। হাজারীবাগ ট্যানারির শ্রমিক কাঁপিয়েছেন ঢাকার রাজপথ। মনজুরুল আহসান খান আর বেলায়েত হোসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনই বাংলাদেশে সড়কের শ্রমিকদের একমাত্র সংগঠন ছিল, যেখানে চাঁদাবাজি ছিল না; ছিল না মাফিয়া চক্র। যে ব্যক্তি অসংখ্য বিপ্লবী সৃষ্টি করেছেন; হায়দার আকবর খান রনোর দৃষ্টিতে তিনিই হয়েছেন অবিপ্লবী।
এটি বলতে পেরেছেন দ্বিতীয় যে অভিযোগটি তিনি কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে তুলেছেন, সেই কারণেই। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের মডেল সমাজতন্ত্র যখন ভেঙে যায়, তখন তার নেতিবাচক ঢেউ সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে আছড়ে পড়ে। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে তিনটি মত পরিলক্ষিত হয়। একটি কমিউনিস্ট পার্টি যেভাবে সংগ্রাম করছে, সেভাবেই সংগ্রাম করে যাবে। দ্বিতীয়টি কমিউনিস্ট পার্টি রূপান্তরিত হয়ে নতুন সংগ্রামের পথ সৃষ্টি করবে; তৃতীয়টি প্রকাশ্য না অপ্রকাশিত, সেটি হচ্ছে- এই অংশ আর কমিউনিস্ট পার্টি করবে না। সোভিয়েত রাশিয়ার মডেল সমাজতন্ত্রের বিলুপ্তিতে তাদের কাছে মনে হয়েছে, সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা হিসেবে অকার্যকর। এর পর তিনটি ধারা দুটি ধারা হয়। একটি হচ্ছে, পার্টি যেভাবে চতুর্থ কংগ্রেস পর্যন্ত চলছিল সেভাবেই চলবে। আরেকটি রূপান্তরিত কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৯৩ সালের জুন মাসে পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রূপান্তরের পক্ষে গেলেও সারাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি সদস্য পার্টির পক্ষে অবস্থান নেন। যে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা রূপান্তরিত হওয়ার দিকে যান, তাঁদের বড় অংশ নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে যান বছর দুইয়ের মধ্যে। একটা অংশ গণফোরাম হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলে যায়। হায়দার আকবর খান রনো এই কারণকে গুরুত্ব দিয়েই কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদকে অবিপ্লবী আখ্যা দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। সারা দুনিয়ার বহু দেশেই কমিউনিস্ট পার্টিতে পরিবর্তন এসেছে। পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি সে দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে পরিণত হয়েছে। ১৯১৭ সালে লেনিন রুশ বিপ্লব সংঘটিত করেছেন। ৭২ বছর পর সেই পার্টির সাধারণ সম্পাদক মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত পার্টি বিলুপ্ত করেছেন। তার মানে- লেনিনও বিপ্লবী ছিলেন না, রুশ বিপ্লবও বিপ্লব ছিল না। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সম্পর্কে যে মন্তব্য হায়দার আকবর খান রনো করেছেন; তার মর্মার্থ এটাই দাঁড়ায়। ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই হায়দার আকবর খান রনোকে শ্রদ্ধা করতে চাই। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ যে দু'জন ব্যক্তিকে তুমি বলে সম্বোধন করতেন, তাঁদের একজন হায়দার আকবর খান রনো। হায়দার আকবর খান রনোর সাক্ষাৎকারে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সম্পর্কে অবিপ্লবী মন্তব্য খুবই দুঃখজনক। সিপিবির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাঁর পত্রিকার মন্তব্যও বিস্মিত করেছে অনেককে। হায়দার আকবর খান রনোর মতো ব্যক্তিদের কাছে তরুণ প্রগতিশীল কর্মীদের প্রত্যাশা অনেক।
রুস্তম আলী খোকন: সাবেক ছাত্রনেতা
কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে হায়দার আকবর খান রনোর মূল অভিযোগ দুটি। একটি কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ছাত্র ইউনিয়নকে বড় সংগঠনে পরিণত করলেও শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর কোনো কাজ ছিল না। দ্বিতীয়ত, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের হাতে গড়া কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ সদস্য ১৯৯৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন। এ দুটি কারণে হায়দার আকবর খান রনোর ধারণা হয়েছে- কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ অবিপ্লবী পথে হেঁটেছেন। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নকে বৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত করেছিলেন। সেটি ছিল বাংলাদেশে বিপ্লবী সৃষ্টির কারখানা। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক, কাজী আকরাম গ্রামগঞ্জের পথে পথে হেঁটেছেন। ঘুমিয়েছেন ক্ষেতমজুরের ভাঙা ঘরে।
তাজুল ইসলাম গিয়েছেন আদমজীতে। এক সময় জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের মূল সংগঠন হয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র। বাংলাদেশ কৃষক সমিতি লাল টুপি পরে রাঙিয়েছে ঢাকার রাজপথ। ১০ নভেম্বর ১৯৮৭, ঢাকা অবরোধে চারদিকে শেখ হাসিনার লাল পতাকা হাতে সহিদুল্লাহ চৌধুরী নামিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। হাজারীবাগ ট্যানারির শ্রমিক কাঁপিয়েছেন ঢাকার রাজপথ। মনজুরুল আহসান খান আর বেলায়েত হোসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনই বাংলাদেশে সড়কের শ্রমিকদের একমাত্র সংগঠন ছিল, যেখানে চাঁদাবাজি ছিল না; ছিল না মাফিয়া চক্র। যে ব্যক্তি অসংখ্য বিপ্লবী সৃষ্টি করেছেন; হায়দার আকবর খান রনোর দৃষ্টিতে তিনিই হয়েছেন অবিপ্লবী।
এটি বলতে পেরেছেন দ্বিতীয় যে অভিযোগটি তিনি কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে তুলেছেন, সেই কারণেই। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের মডেল সমাজতন্ত্র যখন ভেঙে যায়, তখন তার নেতিবাচক ঢেউ সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে আছড়ে পড়ে। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে তিনটি মত পরিলক্ষিত হয়। একটি কমিউনিস্ট পার্টি যেভাবে সংগ্রাম করছে, সেভাবেই সংগ্রাম করে যাবে। দ্বিতীয়টি কমিউনিস্ট পার্টি রূপান্তরিত হয়ে নতুন সংগ্রামের পথ সৃষ্টি করবে; তৃতীয়টি প্রকাশ্য না অপ্রকাশিত, সেটি হচ্ছে- এই অংশ আর কমিউনিস্ট পার্টি করবে না। সোভিয়েত রাশিয়ার মডেল সমাজতন্ত্রের বিলুপ্তিতে তাদের কাছে মনে হয়েছে, সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা হিসেবে অকার্যকর। এর পর তিনটি ধারা দুটি ধারা হয়। একটি হচ্ছে, পার্টি যেভাবে চতুর্থ কংগ্রেস পর্যন্ত চলছিল সেভাবেই চলবে। আরেকটি রূপান্তরিত কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৯৩ সালের জুন মাসে পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রূপান্তরের পক্ষে গেলেও সারাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি সদস্য পার্টির পক্ষে অবস্থান নেন। যে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা রূপান্তরিত হওয়ার দিকে যান, তাঁদের বড় অংশ নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে যান বছর দুইয়ের মধ্যে। একটা অংশ গণফোরাম হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলে যায়। হায়দার আকবর খান রনো এই কারণকে গুরুত্ব দিয়েই কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদকে অবিপ্লবী আখ্যা দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। সারা দুনিয়ার বহু দেশেই কমিউনিস্ট পার্টিতে পরিবর্তন এসেছে। পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি সে দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে পরিণত হয়েছে। ১৯১৭ সালে লেনিন রুশ বিপ্লব সংঘটিত করেছেন। ৭২ বছর পর সেই পার্টির সাধারণ সম্পাদক মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত পার্টি বিলুপ্ত করেছেন। তার মানে- লেনিনও বিপ্লবী ছিলেন না, রুশ বিপ্লবও বিপ্লব ছিল না। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সম্পর্কে যে মন্তব্য হায়দার আকবর খান রনো করেছেন; তার মর্মার্থ এটাই দাঁড়ায়। ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই হায়দার আকবর খান রনোকে শ্রদ্ধা করতে চাই। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ যে দু'জন ব্যক্তিকে তুমি বলে সম্বোধন করতেন, তাঁদের একজন হায়দার আকবর খান রনো। হায়দার আকবর খান রনোর সাক্ষাৎকারে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সম্পর্কে অবিপ্লবী মন্তব্য খুবই দুঃখজনক। সিপিবির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাঁর পত্রিকার মন্তব্যও বিস্মিত করেছে অনেককে। হায়দার আকবর খান রনোর মতো ব্যক্তিদের কাছে তরুণ প্রগতিশীল কর্মীদের প্রত্যাশা অনেক।
রুস্তম আলী খোকন: সাবেক ছাত্রনেতা
- বিষয় :
- প্রতিক্রিয়া
- রুস্তম আলী খোকন