সাক্ষাৎকার: আহমদ রফিক
সমাজ বদলের স্বপ্নটি স্বপ্নই থেকে গেল

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: এহ্সান মাহমুদ
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৪:৩৩
ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিক ১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন 'রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্ট'। তিনি 'রবীন্দ্রচর্চা' পত্রিকার সম্পাদক এবং ২০টির বেশি রবীন্দ্রবিষয়ক বই রচনা করেছেন। ১৯৯৫ সালে 'একুশে পদক' ছাড়াও ২০১১ সালে বাংলা একাডেমির 'রবীন্দ্র পুরস্কার' লাভ করেন। রবীন্দ্রচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে 'রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য' উপাধি প্রদান করে। 'রবীন্দ্রভুবনে পতিসর', 'ভাষা আন্দোলন', 'ভাষা আন্দোলন :টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া', 'দেশবিভাগ :ফিরে দেখা' তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। আহমদ রফিকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়।
সমকাল: আপনার সঙ্গে কথা বলছি জন্মদিনের আগমুহূর্তে। আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। এবার আপনি ৯৪ বছরে পা রাখছেন। এই যে নতুন একটি বছর শুরু করতে যাচ্ছেন- বিষয়টি কীভাবে দেখেন? এই সময়ে এসে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি মিলিয়েছেন কিনা?
আহমদ রফিক: আমি আসলে জন্মদিন পালনে বিশ্বাসী না। নিজের উদ্যোগে জন্মদিন কখনও পালন করিনি। আমি মনে করি, জীবন থেকে আরও একটি বছর চলে গেল। তাই জন্মদিনে উৎসব করাটা আমার কাছে জরুরি মনে হয় না। তবে এই সময়ে বাসায় কেউ কেউ আসেন, খোঁজখবর নিয়ে যান- এটুকুই। আগে ভাবতাম, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি আয়ু পাওয়া গেল। এখন এটাকে দীর্ঘজীবনের বিড়ম্বনা বলা যায়। এই বিড়ম্বনা জাগতিক এবং পূর্বাপর। আমার জীবনটা এক ধরনের বহুমাত্রিক লড়াই। স্বভাবতই কিছু অতৃপ্তি থাকবে। সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়; মূলত আদর্শিক। সমাজ বদলের স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল। এ ছাড়া লেখালেখি নিয়ে অতৃপ্তি রয়েছে।
সমকাল: এই যে বয়স বেড়ে যাচ্ছে। মৃত্যুচিন্তা আপনাকে ভাবায় কিনা?
আহমদ রফিক: মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। সময়ের কারণে দেহে বার্ধক্য এসেছে। এটা তো ন্যাচারাল। এটাকে অস্বীকার করব কী করে? আমাদের দেহ নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এতটা বছর পেরিয়ে এসেছে, কষ্ট সয়েছে। তাই তার একটি সময়ে বিশ্রামের প্রয়োজন হবেই। তখনই দেখা দেয় বার্ধক্য। আর বার্ধক্য দোষের কিছু নয়। মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। তাই মৃত্যু নিয়ে আলাদা করে ভাবতেও হয় না। তবে অসুস্থতা ভাবায়। জীবনের বড় একটি সময় পড়াশোনা এবং লেখাকেই কাজ হিসেবে নিয়েছিলাম। এখন চোখের সমস্যায় সব বন্ধ। এটা নিয়ে দুঃখবোধ আছে।
সমকাল: আপনি আত্মজৈবনিক বই 'দুই মৃত্যুর মাঝে নান্দনিক একাকিত্বে' রচনা করেছেন। বইটি প্রকাশ হয়েছে গত বছর। নিজের শৈশব বইয়ের পাতায় তুলে আনা কেমন ছিল?
আহমদ রফিক: বাবা মারা গিয়েছেন আমার একেবারে শৈশবে। মা সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। ছোটবেলায় আমি খুবই চুপচাপ প্রকৃতির ছিলাম। নিজের মতো করে থাকতাম। মা যাতে বিরক্ত না হন এভাবেই থাকতাম। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই দুটো বিষয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল- রাজনীতি ও সাহিত্য। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনীতি ও কবি নজরুলের কবিতা আমাকে সেই সময়ে আকর্ষণ করেছিল। আমার শৈশব খুব রঙিন ছিল না।
সমকাল: আপনি নিজেকে সব সময় একজন মার্ক্সবাদী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। মার্ক্সবাদে কখন আগ্রহী হলেন? জীবনের এই পর্যায়ে এসে মার্ক্সবাদে আপনার আস্থা কতটুকু?
আহমদ রফিক: কাজী নজরুল ইসলাম ও সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক দর্শন আমাকে শৈশবেই মুগ্ধ করেছিল। আমাদের সময়ের অনেক তরুণের মতো দেশবিভাগ আমি চাইনি। আমি পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষেই ছিলাম। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম- দেশভাগ সাম্প্রদায়িক চেতনার। তাই স্বাধীন পাকিস্তান নয় বরং স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতাম। আর তাতে কবি নজরুল ও সুভাষ বসুকে আদর্শ মনে হতো সেই সময়। হাই স্কুলে পড়ার সময় কিশোর বয়সেই ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। দাঙ্গার বছর ১৯৪৬ সালে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম বর্ধমানের প্রাদেশিক সম্মেলনে। সেই চল্লিশের দশকে খুব কম মুসলমান ছাত্রই ছিল, যারা পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিল না। আমি সেই ব্যতিক্রমী ছাত্রদের একজন হিসেবে শুরু থেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলাম। আর মার্ক্সবাদী আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই তখন থেকেই। এখনও মার্ক্সবাদী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে চাই। মার্ক্সবাদে আগ্রহ, মার্ক্সবাদী রাজনীতি ও সাহিত্যপাঠ শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকে। এতে উৎসাহ-আগ্রহ জুগিয়েছিলেন আমার এক অগ্রজ, সেলিমদা। আর এই চর্চা মনন ও সৃজনে গতি পায় ঢাকায় এসে কলেজ জীবনে।
সমকাল: এর পর তো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। মামলা হলো। নিয়মিত পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটল। বিষয়টিকে কীভাবে দেখতে চান এখন?
আহমদ রফিক: ঢাকা মেডিকেলে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার পরও আমার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতি। এতে প্রবল মগ্নতার কারণে ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসন জারি (ইস্কান্দার মীর্জার গভর্নরি শাসন), ব্যাপক গ্রেপ্তার আমার ছাত্রজীবনে কালো ছায়া ফেলে। গ্রেপ্তার এড়াতে বছরখানেকেরও বেশি সময় আত্মগোপনে দুঃসহ জীবন যাপন করতে বাধ্য হই। এতে উচ্চশিক্ষা ব্যাহত হয়। অনেক সময় ব্যয় করে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর বাধ্যতামূলকভাবে ভিন্ন ধারায় (ড্রাগ সেক্টর) কাজ করতে বাধ্য হই। তবে আমার রাজনৈতিক বন্ধু বা সহপাঠী অনেকেরই জীবনে এমন বিপর্যয় ঘটেনি; যেমনটা আমার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। এখন বলতে পারি, ঘটনা আমার প্রতি বিরূপভাবেই ঘটেছিল।
সমকাল: নিজের জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বিষয়ে বলুন...
আহমদ রফিক: নিজের জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। তবে যৌবনে যে স্বপ্ন নিয়ে মার্ক্সবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম, সে স্বপ্নটা বৃথাই গেল। সেটা এখন আর বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে হয় না। আমাদের দেশেও এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন কিছু বিশিষ্ট প্রতিভাধর ব্যক্তি, কিছু সংগঠন। কিন্তু সেই প্রতিভাধর ব্যক্তি ও সংগঠন আমাদের দেশে নেই। এটা যতদিন না হবে, ততদিন পরিবর্তনের কোনো আশা নেই। যেই স্বপ্নটা নিয়ে শুরু করেছিলাম, তা ব্যর্থ হবে- এই হতাশা নিয়েই একদিন চলে যাব।
সমকাল: সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীরা কেউ কেউ মনে করেন, পৃথিবীর সবাইকে একদিন সমাজতন্ত্রে ফিরতে হবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
আহমদ রফিক: একই রকম নির্দিষ্ট যুক্তি দিয়ে সব সময় সব কিছু চালিয়ে নেওয়া যায় না। কারণ সময় বদলায়, তথ্যাদি বদলায়। বদলায় সামাজিক অবস্থা ও যুক্তি। সমাজতন্ত্র তথ্য, যুক্তি ও সময়ের বদলের সঙ্গে বদল ঘটে। তাই পৃথিবীর সবাই একত্রিত হবে- এটা আশা করা যায় না।
সমকাল: তাহলে সেই সময়ে শুরু করেছিলেন কোন স্বপ্ন নিয়ে?
আহমদ রফিক: সমাজ পরিবর্তন ও শ্রেণিবৈষম্য কমাতে শুরু করেছিলাম। আমি শ্রেণিবৈষম্য দূর করব বলি না। শ্রেণিবৈষম্য হ্রাস করতে চেয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। এই হতাশা আছে, থাকবে।
সমকাল: আর কোনো কাজ, যা শেষ করতে পারেননি বলে আক্ষেপ রয়েছে?
আহমদ রফিক: বহু দিন ধরেই চোখের সমস্যা। এখন পড়া এবং লেখা দুটোই বন্ধ হয়ে আছে। বাংলা একাডেমির জন্য রবীন্দ্রজীবনী শেষ খণ্ডের কাজটি করতে পারছি না। কোনো চিকিৎসায় চোখটা ভালো করা গেলে এই কাজটি শেষ করতে পারতাম।
সমকাল: এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
আহমদ রফিক: সমকালকেও ধন্যবাদ জানাই। শুভকামনা।
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার
- আহমদ রফিক