ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

হলি আর্টিসান থেকে কঙ্গো

হলি আর্টিসান থেকে কঙ্গো

সুধীর সাহা

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৪:১৬

কঙ্গোয় নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন গত ২৯ জুন জাতিসংঘকে কঙ্গোর পরিস্থিতি বিশেষ করে জঙ্গি তৎপরতার কাহিনি শোনাচ্ছিল। নারী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট জুলিয়েন লুসেঞ্জ একটি রুদ্ধশ্বাস ঘটনার বর্ণনা করলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উপস্থিত সদস্যরা স্তম্ভিত হয়ে যান। কঙ্গোর গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে দুই দশক ধরে সেখানে জাতিসংঘ নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন আছে। জুলিয়েন মূলত জঙ্গিদের হাতে বন্দি এক নারীর করুণ কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন। সেই নারীকে মানুষের মাংস রেঁধে খেতে বাধ্য করে জঙ্গিরা। ধর্ষিতা নারীর কাহিনিতে স্তব্ধ হয়ে যান জাতিসংঘের সদস্যরা। জঙ্গিরা ওই নারীকে দু'বার অপহরণ করেছিল। এমন পর্যায়ে অত্যাচার চলেছে, তরুণীকে বারবার ধর্ষণের পাশাপাশি মানুষের মাংস রেঁধে তা খেতে বাধ্য করেছিল। কঙ্গোর ওই নারী কোডেকো জঙ্গিদের কাছ থেকে অন্য এক অপহৃত কে ছাড়াতে গিয়ে নিজেও অপহৃত হন। তারপর তাঁর সামনেই একজনের গলা কেটে ফেলে জঙ্গিরা। এর পর গলাকাটা দেহ থেকে অন্ত্রটি খুবলে বের করে মহিলার দিকে এগিয়ে দেয় এবং তাঁকে সেই অন্ত্র রান্না করার নির্দেশ দেয়। সেই রান্না করা অন্ত্রই খেতে হয় মহিলাকে। এখানেই শেষ নয়। ক'দিন পর মহিলাকে কোডেকো জঙ্গিরা ছেড়ে দেয়। বাড়ি ফেরার পথে আবার তাঁকে অপহরণ করে অন্য এক জঙ্গিগোষ্ঠী। সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। বারবার দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং মানুষের মাংস রেঁধে খাওয়া। শেষ পর্যন্ত মহিলাটি ভাগ্যবশত সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।

বাংলাদেশের গুলশানে হলি আর্টিসানে ঘটে যাওয়া হামলার এরই মধ্যে ছয়টি বছর পার হয়ে গেছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই এ হামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জনকে হত্যা করেছিল জঙ্গিরা। নৃশংস এ জঙ্গি হামলায় ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয়, ১ জন বাংলাদেশি-আমেরিকান এবং ২ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছিলেন। জঙ্গিদের প্রতিহত করতে গিয়ে বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ এবং ডিবির সহকারী কমিশনার রবিউল করিমও সেদিন নিহত হন। কেন তারা এই জঙ্গি হামলা করেছিল? জঙ্গিদের মূলত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল। এক, কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা কূটনৈতিক এলাকার ভেতরে ঢুকে হামলা চালিয়ে নিজেদের সামর্থ্যের পরিচয় দেওয়া। দুই, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে বুঝিয়ে দেওয়া তারা কতটা বেপরোয়া ও নৃশংস হতে পারে এবং তিন, বাংলাদেশে বিদেশিদের হত্যার ঘটনায় বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ।

বাংলাদেশের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জঙ্গি দমনে পুলিশের বিশেষ অ্যান্টিটেরোরিজম ইউনিট অনুমোদন পায়। ২০১৯ সাল থেকে এই বিশেষ বাহিনী কাজ শুরু করে। জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালু আছে বলে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তবে অবস্থার উন্নতি হওয়ার মানে এই নয় যে, ভবিষ্যতে দেশে জঙ্গি হামলার ঝুঁকি নেই। এখানে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই; যেহেতু বিশ্বের অনেক অঞ্চলই এখন পর্যন্ত জঙ্গিবাদের অভিশাপ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অনুকূল পরিবেশ পেলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। ঝুঁকি বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থানে আছে ভুটান। বর্তমানে ভুটানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। জঙ্গিবাদ মূলত একটি মতবাদের বহিঃপ্রকাশ। কোনো মতবাদকে সমূলে ধ্বংস করার কাজটি কখনও সহজ ছিল না, এখনও নেই। তবে সেই মতবাদের ঘৃণ্য অবস্থান জনমনে পরিস্কার করতে পারলে এবং জনগণের সমর্থন থেকে তারা বঞ্চিত হলে ধীরে ধীরে জঙ্গিদের মধ্যে মানুষের ক্ষতি করার প্রবণতা কমতে পারে।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে, রাজনীতিকে, জনগণকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সদা প্রস্তুত থেকে সর্বাত্মক প্রতিরোধ করতে হবে। মানুষকে ভালোবাসা, জীবনকে রক্ষা করা এবং ভুল পথের মতামতকারীকে সরিয়ে আনার বিষয়টি রাষ্ট্রের মূল দায়িত্বের অংশ হতে হবে। তা না হলে আজ কঙ্গোর যে হৃদয়বিদারক কাহিনি শুনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যরা আঁতকে উঠছেন, কাল তা-ই হয়ে উঠবে তাদের কাছে সয়ে যাওয়ার ইতিহাস। তা হয়তো ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে।

সুধীর সাহা: কলাম লেখক
[email protected]

আরও পড়ুন

×