ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

যাপিত জীবন

কভিড-১৯ ও তার অভিঘাত

কভিড-১৯ ও তার অভিঘাত

বেবী সাউ

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২২ | ০৮:৪০ | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২২ | ০২:২০

মানুষ জন্ম থেকেই মানিয়ে নিতে শেখে। ভালো কিংবা মন্দ মানিয়ে নিতে নিতে সে একটা সময়কে পার করে দেয়। আর সেখান থেকে তৈরি হয় ইতিহাস। কিন্তু এই যে মানিয়ে নেওয়া, সমঝোতা, পাল্টে ফেলে অনেক কিছু। চিন্তাধারার যেমন আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়, তেমনি চারপাশের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হতে বুঝে নেয় কীভাবে সামলে ওঠা যায় সময়টিকে। শুধু মানুষ কেন, সব উদ্ভিদ-প্রাণিকূলই বোধহয় এটা করে। তার জন্য তাকে ত্যাগ করতেও হয় অনেক কিছু। আর তার ছাপ আমরা পাই যুগে যুগে রচিত সাহিত্যে। কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটি ব্যাধি যে কীভাবে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষাকে প্রভাবিত করতে পারে, তার প্রমাণ আমরা বিশ্বসাহিত্য, সংস্কৃতির দিকে চোখ ফেরালেই দেখতে পাই। আলব্য কামুর বিখ্যাত উপন্যাস 'প্লেগ'-এ এমনই বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে এক ভিন্ন উপাখ্যান। অসুখ কীভাবে আমাদের জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, অসুখের আতঙ্ক কীভাবে আমাদের ভাষায়, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে এবং অস্তিত্বেও ঢুকে পড়ছে সাহিত্য আমাদের দেখিয়ে দেয়। মহামারি এবং যুদ্ধ যদি না আসত তাহলে কি আর অস্তিত্ববাদী দর্শনের জন্ম হতো? আসলে সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেপথ্যে থাকে এক প্রকার বাস্তবিক ভাঙাচোরার পৃথিবী। যেমনটি ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে, ঠিক তেমনটাই ঘটছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও। যেভাবে গত শতাব্দীর এই ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করেছিল অস্তিত্বের অনেকখানি, তেমনই কি হবে এবারের করোনার প্রভাব? একটি ব্যাধিতে সারাবিশ্বের সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেল আতঙ্ক। মারা গেল অর্ধ মিলিয়নের বেশি মানুষ, মারা যাচ্ছে এখনও। চাকরি চলে গেছে অসংখ্য মানুষের। অর্থনৈতিক অবস্থা গোটা বিশ্বেরই পতনের দিকে। মানুষের মনোজগতেও পড়ছে নানারকম প্রভাব। 

২৩ শে মার্চ, ২০২২ তারিখটা বহুদিন থেকে যাবে পশ্চিমবঙ্গবাসীর স্মৃতিতে। কোন বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার মতোই। বাঙালি যেমন রাজ্য রাজনীতির পটপরিবর্তন, ডাবির হাতাহাতি কিংবা ম্যাটিনির হাউসফুল শো নিয়ে টেবিল চাপড়ে আজও তর্ক করে- এই তারিখটাও তেমন এক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হয়ে যে থেকে যাবে না কে বলতে পারে? এদিন 'লকডাউন' বলে একটা শব্দের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমাদের। আচমকাই বদলে গেল চারপাশের চেনা ছন্দে চলতে থাকা জীবন। বাঙালির রোজকার শব্দকোষে পরপর ঢুকে গিয়েছিল আরও কয়েকটা শব্দ যেমন : কভিড, মাস্ক, রেমডিসিভির, স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন আরও কত কিছু! করোনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমাদের এভাবেই হয়েছিল। পরিচয়টা যে খুব হালকা ছিল, তা তো নয়। কারণ এই পরিচয়ের ফলেই কয়েকদিন পরে আমরা দেখলাম অগণিত লাশের সারি। কারও কারও জায়গা হলো না শ্মশানে। লাশ পড়ে থাকল উঠোনে, রাজপথে, নদীতীরে...। পিতৃহীন, মাতৃহীন হলো অবুঝ সন্তান। দেখলাম, পরিযায়ী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে স্ত্রী, সন্তান, বাবা, মা নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটছেন ঘরে ফেরার জন্য। কেউ কেউ রাস্তাতেই মারা যাচ্ছেন। কেউ বা করছেন আত্মহত্যা। এসবই হয়ে গেল আমাদের অভিজ্ঞতার অংশ। ট্রেনে উঠতে গিয়ে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে, রেললাইনের মধ্যেই হয় কারও কারও শেষ শয্যা। এক একটা মারি আসে আর নতুন দৃশ্যের সম্মুখীন হই আমারা। আমরা চমকে উঠি। কেঁপে ওঠে আমাদের নিশ্চিন্তের যাপন। সময়ের সঙ্গে চলতে চলতে পরিবর্তন তো হয়ই। আর আমাদের স্মৃতির ওপরে এসে পড়ে সময়ের পরত। যেনবা হাঁপ ছাড়ার মতো মনের অবস্থা হয় তখন। যেনবা বেঁচে গেলাম। এই অনুভবের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এ সময় মানুষ কি একটু বেশিই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ল না? ঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে কি অনেক বেশি হয়ে পড়ল না কূপমণ্ডূক? বছর দুয়েক পর এখন করোনা মানেই সেই আতঙ্ক আর নেই। গত বছর পর্যন্তও ভ্যাকসিন, মাস্ক, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং ইত্যাদির যা ওজন ছিল এখন তা একেবারেই নেই। দুই বছরের বন্দিদশা ঝেড়ে ফেলে ভাদ্রের গরম ও প্যাঁচপ্যাঁচে বৃষ্টি উপেক্ষা করেও শহরের রাস্তায় পুজোর কেনাকাটার ঢল নেমেছে। মাস্কের ব্যবহারবিধি বা স্যানিটাইজারের চাহিদা এখন অনেকটা খাতা-কলমে থাকার মতোই ব্যাপার। মানুষ সামাজিক দূরত্বের ব্যাপারেও সব নিষেধাজ্ঞা নিজেরাই তুলে দিয়েছেন। এসব দেখে মনে হতেই পারে জীবন ফের আগের মতোই চলছে। করোনা বলে যে ভাঁজটি আচমকাই আমাদের জীবনে পড়েছিল, তা মসৃণ; এখন সেই অতিমারিকে স্মৃতিতেই রাখার, বাস্তবে তার যেন উলেল্গখ নিতান্তই নামকাওয়াস্তে! সত্যিই কি তাই? অন্তত মানুষ এমনভাবে ভুলে যেতে ভালোবাসে বলেই এই ভুলে যাওয়া যে সত্য, তা তো নয়। জাপানের নাগরিকদের মাস্ক পরার অভ্যাস অনেক থেকেও। ধুলাবালি, হাঁচি, কাশি বা অন্য কোনো সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা শুধু মহামারির সময় নয়, স্বাভাবিক সময়েও ঘরের বাইরে এলে মাস্ক পরে থাকেন। অন্যদিকে অনেক আগে থেকেই ভারত একটি উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হলেও এখনও অনুন্নত একটি রাষ্ট্র, সমাজ এখনও পশ্চাতপদ। এখানে এখনও ৪০ কোটি মানুষ স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহারের সুযোগ পান না। মলমূত্র পরিত্যাগ করে তারা খোলা আকাশের নিচে। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢাকার অভ্যাস অনেক শিক্ষিত লোকেরই নেই। কভিড-১৯ মহামারি একজন গরিব কৃষককেও শিখিয়েছে হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢাকতে, না হলে মৃত্যুও হতে পারে। কিছুক্ষণ পরপর স্যানিটাইজেশন করাও ভারতীয়রা এখন শিখে গেছে এই করোনার বদৌলতেই। 

ইদানীং কালের ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা রাজনৈতিক কারণে ধর্মের ব্যবহার ভারতবাসীকে ভুগিয়েছে এই অতিমারির মধ্যেও। একাধিক জায়াগায় কুম্ভমেলা, রাম মন্দিরের শিলান্যাস, রাজনৈতিক সমাবেশ বহু মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। 

নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি উচ্চবিত্তের যে অবজ্ঞা, অবহেলা আর রাষ্ট্র ও সরকারের তরফ থেকে বঞ্চনার যে সংস্কৃতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিদ্যমান, তাও এই গরিব মানুষক নিদারুণ অসহায়ত্ব, কষ্ট আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এ বছরের মার্চ মাসে একটি সমীক্ষা জানিয়েছে- কভিড-১৯-এর প্রথম বছরে উদ্বেগ ও অবসাদ ২৫% বেড়ে গেছে। সমীক্ষায় এও ধরা পড়েছে যে, ৯০% শতাংশ দেশ তাদের নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে উপযুক্ত পরিষেবা দিচ্ছে। এখান থেকে যে চিত্রটা খুব পরিস্কার বোঝা যায়, তা হলো, বিশ্বজুড়ে চলা এই অতিমারি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলে দিয়েছে। কারণটিও সহজেই অনুমেয়। সামাজিক দূরত্বের শর্ত মানতে গিয়ে কাছের জনদের সঙ্গ বঞ্চিত হয়ে দীর্ঘদিন কাটানো, জীবিকা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ও একাকিত্ব। এমনকি শিশুরাও যার শিকার। প্রায় বছর দুয়েকের স্বাভাবিক সামাজিক জীবন থেকে বিচ্যুতি মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও একমত। কিন্তু সে তো অতিমারির সময়ের কথা। এখন আপাতদৃষ্টিতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক মনে হলেও সেই আগের সুর যেন ঠিক বাজছে না। আমরা কি তবে একাকিত্বকে, নির্জনতাকে সর্বোপরি স্বেচ্ছানির্বাসনকে মেনে নিতে শিখে যাচ্ছি!

তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশই করোনার সময় ফোন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের শরণাপন্ন হয়ে পড়েছিল। সময় কাটানোর প্রশ্ন তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার স্বাদ। যা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই এই মাধ্যমগুলো থেকে পেতে হয়েছিল। ফলে ব্যবসায়িক নীতিতেও এই মাধ্যমগুলো একা মানুষের সঙ্গ হয়ে ওঠার কথা বলা শুরু করেছিল এবং একাকী জীবনের সঙ্গীরূপেই তারা নিজেদের তুলে ধরেছে। দীর্ঘদিন বন্ধুবান্ধবহীন, প্রবাসে অতিমারির কারণে আটকে যাওয়া মন একে আঁকড়ে ধরবে আর সেটাই স্বাভাবিক! কিন্তু এখনও সেই নির্ভরশীলতা পুরোপুরি চলে গেছে বলা যায় না। নেটফ্লিক্সে বিঞ্জ ওয়াচ একঘর লোকের সঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়ার চেয়ে মনোগ্রাহী লাগতেই পারে! তাহলে কি আমাদের অভ্যাস বদলে গেল?

এই অভ্যাসের বদল, একটু লক্ষ্য করলে আমাদের চারপাশে আরও দেখা যাবে। অনেকেই যাতায়াতের ব্যাপারে এখনও ভয়টা যেন ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। করোনা-পূর্ববর্তী ট্রেন, বাস, অটোর সহজ ফান্ডার চেয়ে ওলা বা উবারের সামর্থ্য থাকলে তাই বেছে নেওয়ার ঝোঁকটাই বেশি বলেই মনে হয়। বাড়ির বয়স্কদের চিরাচরিত রোজ বাজারে যাওয়া, চায়ের দোকানের আড্ডাতেও কোপ পড়েছে। হাতের কাছে রয়েছে অনলাইন শপিং। আগে শুধু জামাকাপড়, সাজগোজের জিনিস, ঘরের টুকিটাকির জন্যই অনলাইন শপিং অ্যাপগুলোর চাহিদা ছিল। করোনার পরে বাড়ির গৃহিণীরা রোজকার মাছ-মাংস, মুদিখানার জিনিসের জন্য এখন অনলাইন বাজারের শরণাপন্ন হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এতে ঘরে বসেই যেমন পছন্দসই জিনিসটি হাতে চলে আসছে, বাড়ির বৃদ্ধ মানুষটিকেও বাইরে যাওয়া, রোগের আশঙ্কার মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর হাত থেকে আটকানোও যাচ্ছে! আর ছোটখাটো ব্যবসায়ীরাও শিখে নিয়েছেন হোম ডেলিভারি, অনলাইন ট্রানজেকশনের মতো বিষয়। তাঁরাও নিজেদের মতো করে ক্রেতাকে যতটা কম ঝঞ্ঝাটে হাটবাজার করার সুবিধা দিচ্ছেন। সর্বোপরি, করোনার আবির্ভাবে এই হাটবাজার, টাকা-পয়সা লেনদেনের ক্ষেত্রে একধরনের সামাজিক বিপ্লবই ঘটে গেছে। বিপ্লব- কারণ করোনা-পরবর্তী এই ধারা অব্যাহত আছে।

বড়দের পরিবর্তনটা অনেকটা আশাজনক হলেও ছোটদের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনটা কোন দিকে কী রকম, তা বলা কঠিন। বহু শিক্ষাবিদ ও শিশু মনস্তত্ত্ববিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, করোনার সময় ক্লাসরুম, স্কুলের নিয়ম-কানুন, পরীক্ষা পদ্ধতি ও পড়াশোনার গোটাটাই অনলাইনে হওয়ার ফলে শিশু-কিশোররা তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার জায়গা থেকে অনেকটাই সরে গেছে। ফলে নতুন করে স্কুলের পরিবেশে, ক্লাসরুমের মধ্যে তাদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাবা-মায়েদেরও আরেকটি চিন্তার কারণ শিশুদের হাতে স্মার্টফোন দেওয়া নিয়ে। অনেক স্কুলই এখনও অনলাইনে লেসন প্ল্যান, হোমওয়ার্ক, প্রশ্নোত্তর পাঠানোর সুবিধা ছাড়েনি। কিন্তু ক্রমাগত স্মার্টফোন হাতে থাকলে শিশু-কিশোরেরা যে তার খারাপ দিকগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! এ কারণে অভিভাবকদের প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া দীর্ঘদিন বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা থেকে দূরে থাকায় শিশুদের মধ্যে একাকিত্বের বোধ তৈরি হয়েছে। বর্তমানের দম্পতিকেন্দ্রিক পরিবারে বাবা-মাও ব্যস্ততার কারণে শিশুদের সঙ্গ দিতে পারেন না। সবমিলিয়ে শিশু-কিশোরদের মনে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মনোবিদরা। শিক্ষক-শিক্ষিকা ও বাবা-মায়েদের আরও সহানুভূতি, সহমর্মিতা না থাকলে শিশুরা তাদের স্বাভাবিক জীবন পুরোপুরি ফিরে পাবে না। সুতরাং এই সামাজিক দূরত্ব, গৃহবন্দি থাকা ছোটদের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত নঞর্থকতাই এনে দিয়েছে বলা চলে।

এ তো গেল সামাজিক পটপরিবর্তনের কথা। করোনা আমাদের মনোজগতেও বড় ঢেউ তুলে দিয়েছে। এর সঙ্গে বদলেছে বিনোদনের সংজ্ঞা ও রুচি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ও ওটিটি পল্গ্যাটফর্মের দৌলতে দেশ-বিদেশের বহু সিনেমা, সিরিজ এখন স্রেফ একটি ক্লিকের দূরত্বে। ফেসবুক, টুইটারের দৌলতে আগেকার সেলিব্রিটি ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার ব্যবধানও এখন অনেকটাই তিরোহিত। আপনার পছন্দের পরিচালক বা অভিনেতা আপনার প্রশংসা বা সমালোচনায় সাড়া দিতেই পারেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দৌলতে। আর আপনি নিজের ঘরের চৌহদ্দিতে বসেই আচমকা গোটা পৃথিবীর কাছে পরিচিত মুখ হয়ে উঠতে পারেন চাইলেই। তার জন্য প্রয়োজন কনটেন্ট ও দর্শক। আর একবার যদি 'ভাইরাল' হয়ে যান আপনিও বিনোদন জগতের নক্ষত্র যে হয়ে উঠবেন না, তাই বা কে বলেছে? করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে সম্ভবত অন্তর্জালের এই ভূমিকাটিই মানুষের সামাজিক জীবনের সবচেয়ে বড় আলোড়ন। দীর্ঘদিনের সামাজিক দূরত্ব ও স্বেচ্ছাবন্দিত্ব আপনাকে আপনার পরিচিত পৃথিবী থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও অন্তর্জাল আপনাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে আরও বৃহত্তর পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে। 

ভুবনায়ন বৃহত্তর অনেকাংশে বদলে দিয়েছে আমাদের চিরাচরিত রুচিবোধ। নতুন শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। একই ধরনের গল্প, একই ধাঁচের গান থেকে বেরিয়ে নতুন প্রজন্ম বিভিন্ন শিল্পশৈলীর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। ঘরে বসেই আলোচনা করতে পারছে গ্রহের অন্যপ্রান্তের মানুষের সঙ্গে, পরিচিত হচ্ছে তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় পাওয়া। যদি করোনার ভালো দিক কেউ দেখতে চান, এটি অবশ্যই তার একটা। আরেকটি হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি পুনরায় শ্রদ্ধা ও সম্মান ফিরে আসা। আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হলেও করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউতে আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের স্বার্থ না দেখে যে পরিষেবা দিয়ে গেছেন, তা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। আশা করা যায়, এই স্মৃতি এর পরে জনসাধারণের মনে শ্রদ্ধার উদ্রেক করবে। খবরের কাগজ খুললেই চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা দেখতে হবে না! আরও যে বিষয়টি সম্ভবত করোনা না এলে আমাদের চিন্তায় আসত না, তা হলো নিজের সঙ্গে সময় কাটানো। আমরা একবিংশ শতাব্দীর নিয়ম মেনেই ইঁদুর-দৌড়ে কমবেশি সবাই শামিল হয়েছিলাম। পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ ঠিক কতটা মূল্যবান তা বোঝা যেত না। বোঝা যেত না সম্পর্কের মূল্য। ব্যস্ততার অজুহাতে বহু পুজোর আড্ডা, পারিবারিক অনুষ্ঠান আমাদের হারাতে হতো। করোনার আচমকা আবির্ভাব আমাদের একাকী জীবনে ঠেলে দেওয়ায় নিজের সঙ্গে নিজে সময়ে কাটানোর সুযোগটিও যেমন দিয়েছিল, তেমনি আশপাশের সম্পর্কগুলোকেও নতুন চোখে দেখতে শিখিয়েছে বললে ভুল হবে না।

জলের ভিতরে বসে শুকনো থাকার মতো করোনাকে বাদ দিয়ে আমাদের জীবন আজ অসম্ভব। করোনা হয়তো আর কখনও যাবে না সম্পূর্ণভাবে। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সংস্কৃতিবোধকে করে তুলতে হবে অনেক বেশি অন্যরকম। তা যেন বদ্ধতার মধ্যে থাকতে থাকতে বদ্ধ না হয়ে পড়ে। একটি অতিমারি অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে বহু পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়, তা সবাই জানেন। তার সঙ্গে মনে ও মননেও পরিবর্তন ঘটায়। তার সবটাই ভালো বা সবটাই খারাপ তা হলফ করে বলা যায় না কখনওই। করোনা-পূর্ববর্তী জীবন ভালো ছিল না পরবর্তী তা নিয়ে তর্কের অবকাশ তো থাকবেই, থাকবে স্মৃতিচারণা এবং একটি উহ্য প্রার্থনা, আর যেন এই অতিমারি না ফিরে আসে, বা মৃত্যুর করাল ছায়া আমাদের ওপর না পড়ে। তবে পরিবর্তনকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আর জীবনের নিয়মই তো তাই! শুধু জীবন কেন? এই মহাবিশ্বের সবকিছুই সতত পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই পরিবর্তন যেন হয়ে ওঠে ইতিবাচক, সেটাই আমাদের প্রার্থনা। নেতিবাচক হয়ে পড়ার যথেষ্ট কারণ থাকলেও আমরা যেন আত্মশক্তিতে অতিক্রম করতে পারি এই নেতিবাচক অবস্থাকে। কারণ, গত তিন বছর ধরে যে অবস্থাকে আমরা পেরোতে পেরোতে আসছি, তার পরে নতুন করে জেগে ওঠা আমাদের খুব দরকার। তা না হলে শূন্যতার এক দর্শন আমাদের আবদ্ধ করে ফেলবে দ্রুতই।

আরও পড়ুন

×