ডিজিটাল বাংলাদেশ
স্মার্ট বাংলাদেশ: প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা

অজিত কুমার সরকার
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২২ | ১৪:৫৮
যে কোনো পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা বা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরবির্তনের শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে ওঠে তখনই, যখন তাতে সন্নিবেশিত হয় লক্ষ্যনির্ভর সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসূচি। আমাদের সামনে এর উজ্জ্বলতম উদাহরণ ডিজিটাল বাংলাদেশ। রূপকল্প ২০২১-এর মূল উপজীব্য ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য অর্জনে প্রণয়ন করা হয়েছিল প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২১। এ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অভাবনীয় সফলতা আসে। এমনকি ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত সরকারি সেবার পদ্ধতিও ক্রমে পরিবর্তন হচ্ছে। সরকারি ক্রয়সহ অনেক সেবাই এখন অনলাইনেও সহজলভ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাস্তবায়িত অসংখ্য উদ্যোগের মধ্যে ভালো অনুশীলনের অন্তত ১১টি উদ্যোগ রয়েছে, যা নাগরিকদের আর্থসামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখায় তা কয়েকটি রাষ্ট্র তাদের দেশে হুবহু বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে এক ঠিকানা থেকে সরকারি সেবা দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম 'আমার সরকার' (মাইগভ) এবং চাকরিদাতা ও চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির প্ল্যাটফর্ম 'ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ফর স্কিলস, এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিউরশিপ (এনআইএস)' যথাক্রমে ফিলপাইন ও সোমালিয়ায় বাস্তবায়নের জন্য তাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছে সরকার। সুপরিকল্পনার কর্মসূচির সাফল্য যে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশে বাস্তবায়ন হতে পারে- এটি তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ। প্রাসঙ্গিকভাবে এমন উদাহরণ তুলে ধরা হলো মূলত স্মার্ট বাংলাদেশ মাস্টার প্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) নিয়ে আলোচনার জন্য।
এ মহাপরিকল্পনাকে বলা যায় ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের সোনালি পথনকশা দলিল। এতে ২০৪১ সালের মধ্যে জাতীয় অর্থনীতিতে আইসিটি খাতের অবদান ২০ শতাংশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমির আলোকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এ জন্য ৪০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি স্তম্ভের বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট সময়ে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যেমন ইউনিভার্সাল আইডির কথাই ধরা যাক। এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০২৫ সালের মধ্যে ডিজিটাল আইডি গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি, ২০৩১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে শতভাগ।
মহাপরিকল্পনায় স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে প্রতিটি প্রকল্প বা কর্মসূচির ব্যাপ্তি ২০২৫, ২০৩১ ও ২০৪১-এর সময়রেখার মধ্যে রেখে ছোট ছোট ভাগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ৪০-এর বেশি মেগা প্রকল্পের প্রতিটিকে চার স্তরে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ২০৪১-এর লক্ষ্য অর্জনে পৌঁছতে হবে। স্তরগুলো হলো- চালু, স্থায়ীকরণ, মানদণ্ড প্রস্তুতকরণ ও উত্তরণ। মহাপরিকল্পনার চার স্তম্ভের আওতায় তিনটি বিভাগে সুনির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রম গ্রহণ এবং তা শুরুর প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন- বিভাগ এক. অবিলম্বে চালুকরণ (২০২৩ সালের মধ্যে); বিভাগ দুই. স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি প্রকল্প (২০২৩-২৪-এর মধ্যে) এবং বিভাগ তিন. মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প (২০২৩-২৪-এর পরে)। তিনটি বিভাগের নির্ধারিত সময় অনুযায়ী যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তা হলো, বিভাগ এক. ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলা ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি, আইসিটি নীতিমালা (তথ্য গোপনীয়তা ও সাইবার নিরাপত্তা, বাণিজ্য সহজীকরণ), জাতীয় প্রকিউরমেন্ট ই-বাজার, ডিজিটাল চাকরির প্ল্যাটফর্ম, স্মার্ট পাবলিক সার্ভিস (জনপরিষেবা) ও পেপারলেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (কাগজবিহীন প্রশাসন), ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্সিয়াল (অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক সংস্থান), গভর্নমেন্ট ক্লাউড অ্যান্ড ডাটা সেন্টার ইত্যাদি কার্যক্রম শুরুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিভাগ দুই. ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইউনিভার্সাল ডিজিটাল আইডি, ডিজিটাল কারিকুলাম, স্মার্ট ডিভাইস অ্যাকসেস, ডিজিটাল কোলাবরেশন প্ল্যাটফর্ম, স্মার্ট বাংলা ক্যাম্পেইন, স্মার্ট হেলথ কেয়ার, স্মার্ট ট্যাক্স, ব্লেন্ডেড লার্নিং, ডিজিটাল লিডারশিপ একাডেমি ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং বিভাগ তিন. ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে স্মার্ট ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, স্মার্ট পোস্টাল সার্ভিস, স্মার্ট জুডিশিয়ারি, স্মার্ট বর্ডারস, স্মার্ট সোস্যাল সেফটি নেট, পুলিশ মডার্নাইজেশন, ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম, ফিনটেক অ্যাকসেলারেটর, উদীয়মান প্রযুক্তিবিষয়ক সেন্টার অব এক্সিলেন্স (সিওই) বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, স্মার্ট বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলো প্রস্তাবের আগে ডিজিটাল ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সর্বোত্তম অনুশীলনের মডেল পর্যালোচনা ও বিশ্নেষণ করা হয়। তবে বিদেশি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও ভালো অনুশীলনের মডেল পর্যালোচনা ও বিশ্নেষণ করা হলেও কর্মসূচিগুলো নেওয়া হয়েছে দেশের উপযোগী করে এবং বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে। স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এস্তোনিয়ার 'ই-আইডি' মডেল বিশ্নেষণ করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে স্মার্ট সিটিজেন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর মডেল। ই-কমার্স, ব্যাংকিং, সরকারি পরিষেবা ইত্যাদিতে সফলভাবে এর ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া কর্মসূচি গ্রহণে ভিয়েতনামের 'ইউনিভার্সাল স্মার্টফোন প্রোগ্রাম', ভারতের 'আধার', 'ফিউচার স্কিলস প্রোগ্রাম' ইত্যাদি উদ্যোগও বিবেচনায় রাখা হয়। স্মার্ট সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ই-এস্তোনিয়া মডেল দেশটিতে কাগজহীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এ ছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে জাপানের 'কুমোন লার্নিং মোড' সারাবিশ্বে সমাদৃত একটি মডেল। এসব ছাড়াও পর্যালোচনা করা হয়েছে ভারতের 'ই-বাজার', 'পণ্য ও সেবা কর নেটওয়ার্ক', 'ডিজিটাল বাণিজ্যের উন্মুক্ত বাজার' 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া ভূমি নথিবদ্ধকরণ ও ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া' ইত্যাদি। একইভাবে স্মার্ট সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশ্নেষণ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের 'কনসোলিডেটেড ইন্টারঅপারেবল (আন্তঃচালিত) পেমেন্ট ব্যবস্থা, যা সব আন্তঃচালিত পেমেন্ট স্কিমকে একক 'Pay.UK'-এর আওতায় নিয়ে এসেছে। নাইজেরিয়ার 'ফিনটেক অ্যাকসেলারেটর', ভারতের 'ইউপিআই', দক্ষিণ কোরিয়ার 'স্মার্ট শহর' স্মার্ট সমাজ প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম মডেল হিসেবে বিশ্বে সুপরিচিত। স্মার্ট অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার 'চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (ফোরআইআর) পলিসি' ও উদ্যোগগুলোকে পর্যালোচনা করা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রবোটিকস ও ফোরআইআর প্রযুক্তি চালানোর জন্য এমন একটি পলিসি প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া মহাপরিকল্পনার কর্মসূচি প্রণয়নে বিশ্নেষণ করা হয় ইসরায়েলের সাইবার নিরাপত্তা সেন্টার অব এক্সিলেন্স (সিওই) ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম, ভারতের সরকারি ক্লাউড 'মেঘরাজ', 'স্টার্টআপ ইন্ডিয়া', অস্ট্রেলিয়ার 'জাতীয় ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক', সিঙ্গাপুরের 'অর্থনৈতিক উন্নয়ন বোর্ড' উদ্যোগগুলোকে।
সামগ্রিক বিশ্নেষণে দেখা যায়, রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন দ্রুততর করা এবং ২০৪১ সাল নাগাদ একটি স্মার্ট জাতি উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা মহাপরিকল্পনার আলোকে স্মার্ট বাংলাদেশের বাস্তবায়ন শুরু।
অজিত কুমার সরকার: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
- বিষয় :
- ডিজিটাল বাংলাদেশ
- অজিত কুমার সরকার