ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞান আলোচনার সতর্কতা ও শিষ্টাচার

সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞান আলোচনার সতর্কতা ও শিষ্টাচার

সাজেদুর রহমান ও তপন মাহমুদ লিমন

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২২ | ১৫:০৬

সম্প্রতি একটি টেলিভিশন টকশো বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সেখানে দেশের একজন বিজ্ঞানীকে তাঁর গবেষণার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নের ধরন, প্রশ্নকর্তাদের গবেষণা সম্পর্কিত জ্ঞান ও আচরণ দেখে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেরই অভিযোগ, বিজ্ঞানীকে হেনস্তা করা হয়েছে। প্রশ্নগুলোও সাংবাদিকসুলভ ছিল না। আমরা মনে করি, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে সাংবাদিকতার চর্চা ও সীমা নিয়ে নতুন ভাবনার পরিসর তৈরি হয়েছে। বিশেষত বিজ্ঞান ও গবেষণাবিষয়ক প্রতিবেদন, সংবাদ বা টকশো প্রচারে সাংবাদিকদের সতর্কতা ও সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে সামনে এসেছে।

আমরা জানি, কোনো নতুন আবিস্কার বা পুরোনো বিষয়ে ত্রুটি চিহ্নিত করার মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানী বা গবেষকরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আবার তাঁদের গবেষণার ফল সাংবাদিকরা সঠিক ও সহজভাবে জনাসাধারণের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। এ ক্ষেত্রে অসতর্কতায় যেমন বিভিন্ন বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, তেমনি দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা। যেমন বেগুনে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান আছে- এমন খবরে অনেকেরই মনে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে- তাহলে কি আর বেগুন খাওয়া যাবে না? এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেগুন চাষি ও সবজি ব্যবসায়ীরা আকস্মিক লোকসানের মুখে পড়তে পারেন। আবার খবরটি সত্যি হলে বেগুন বাজারজাত নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

এ ধরনের 'স্পর্শকাতর' বিষয়ে তাই প্রতিবেদন বা টকশো বিশেষ সতর্ক ও বিচক্ষণতার সঙ্গে করা দরকার। জনস্বার্থই যেহেতু সাংবাদিকতার মূল বিষয়, তাই সেটা নিশ্চিতে বিজ্ঞানী বা গবেষকের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করে সহজভাবে জিনিসটা বুঝে নেওয়া জরুরি। সে জন্য গবেষকের সঙ্গে আক্রমণাত্মক হওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি বোঝার জন্য অনেক প্রশ্ন করা অবশ্যই দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাতে সৌজন্য বজায় রাখা দরকার। না হলে অযথা বিতর্ক বা উত্তেজনার আড়ালে সঠিক বিষয়টি জানার পরিবর্তে আরও বিভ্রান্তি তৈরি হবে।

আমাদের পরামর্শ- যে কোনো বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ বা গবেষণাপত্র নিয়ে প্রতিবেদন বা আলোচনা করতে চাইলে প্রতিবেদক বা উপস্থাপক বা আলোচকের উচিত আগে নিজে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করা। যে জার্নালে এটি প্রকাশ করা হয়েছে, তার মান সম্পর্কে আগেই খোঁজ করা। অনুষ্ঠানে বসে গবেষককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করার অর্থ আলোচক বা উপস্থাপকের প্রস্তুতিতে যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

আবার বিজ্ঞানবিষয়ক খবর অতি সহজ করতে গিয়ে ভুল বার্তা যাতে না যায়, সে বিষয়েও সতর্ক হওয়া জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত কোনো কোনো সংবাদপত্র সেটাই করেছে। 'ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়া গেছে'- এমন সরলীকৃত খবর খুবই ভয়ংকর।

এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ও গবেষকেরও দায়িত্ব রয়েছে। গবেষক যখন কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন; সতর্ক থাকতে হবে যে, তাঁর কথায় যেন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়। সংবাদমাধ্যমই হোক আর সামাজিক মাধ্যম; গবেষণার ফল প্রকাশে সাবধানতা অবলম্বন করা গবেষক ও বৈজ্ঞানিকের নৈতিক দায়িত্বও। উন্নত বিশ্বে এখন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কথা বলার জন্য গবেষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

মনে রাখতে হবে, গবেষণাপত্র ও সংবাদপত্রের ভাষায় বিস্তর পার্থক্য। সে জন্য সাংবাদিকদের যেমন গবেষণার ভাষা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা থাকা দরকার; গবেষক ও বিজ্ঞানীরও সংবাদমাধ্যমের উপযোগী ভাষা ও ভাষ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি দরকার।

যেসব গবেষণার সংবাদ-মূল্য রয়েছে, সেগুলোর সংবাদমাধ্যম উপযোগী সারাংশ তৈরি করা জরুরি। এই সারাংশ তৈরির ক্ষেত্রে অন্তত দুটি দিকে খেয়াল রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এক, ভাষা; দুই, সময়।

প্রথমত, ভাষা। মনে রাখতে হবে, সংবাদমাধ্যমের পাঠক, দর্শক ও শ্রোতার মধ্যে সব শ্রেণির মানুষ থাকে। আর গবেষণা প্রবন্ধ সবাই পড়ে না। তার পাঠক মূলত একাডেমিক শ্রেণির। এই ভাষা অনেক সময় সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে থাকে। তাই এমনভাবে সারাংশ করা দরকার, যাতে সব ধরনের মানুষ বুঝতে পারে; আর ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ না থাকে।

যেমন, দেশের কয়জন ক্যাডমিয়াম, কারসিনজেনেসিস, ভারী ধাতু ইত্যাদি বিষয় বুঝতে পারে? আলোচ্য টকশোতে এসব বিষয়ে সাধারণের উপযোগী ভাষ্য থাকলে বিভ্রান্তি এড়ানো যেত। টকশোর মতো অনুষ্ঠানে কী ধরনের আলোচনা হতে পারে, সে বিষয়টিও গবেষক, উপস্থাপক আগেই আলোচনা করে নিতে পারতেন। কারণ কাউকে ধরাশায়ী করে টিআরপি বাড়ানোর চেয়ে জনস্বার্থ বিবেচনায় সঠিক তথ্য তুলে আনাই বেশি জরুরি।

দ্বিতীয়ত, সময়। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে আলোচনার জন্য খুব কম সময়ই পাওয়া যায়। গবেষণার সারাংশ সহজ ও সঠিক ভাষায় এই অল্প সময়ে বলা সহজ নয়। এ জন্য খুব ভালো প্রস্তুতি দরকার। সময়স্বল্পতার কথা মাথায় রেখে সাংবাদিকদের খুব কৌশলী হতে হয়। অনেক সময় একটু কঠোরভাবে বক্তাকে থামিয়েও দিতে হয়। তবে এই কঠোরতার সঙ্গে বিনয় মিশিয়ে রাখা সাংবাদিকের যোগ্যতার প্রমাণ দেয়।

সংবাদমাধ্যমে গবেষণাপত্র বা ফল উপস্থাপন ও আলোচনায় সর্তকতা ও শিষ্টাচার নিয়ে সংবাদপত্রের স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা যায় না। আমরা আশা করছি, বিজ্ঞানবিষয়ক খবর তৈরি বা টকশোর মতো অনুষ্ঠান করতে সাংবাদিক ও গবেষক উভয়ের যথাযথ প্রশিক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে। কারণ এ ধরনের বিষয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবার দায়িত্ব আমাদের সবার।

ড. সাজেদুর রহমান:গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য ও তপন মাহমুদ লিমন: বার্তা সম্পাদক, এখন টেলিভিশন

আরও পড়ুন

×