ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন

নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন

সৈয়দা আশরাফিজ জাহারীয়া প্রধান

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৫:৫৯

সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। ১৯৮৪ সালে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নির্মূলবিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশন অনুমোদন করে বাংলাদেশ। সমান উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নির্মূলে সরকার নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ প্রণয়ন করে। ২০০৪ সালে এই নীতিতে একটি সংশোধনী এনে সরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বাস্তব প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষ করে কভিড মহামারির সময় নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। সহিংসতার শিকার নারীরা দিনের পর দিন মানিয়ে চলছেন এই অমানবিক সংস্কৃতির সঙ্গে।

২০১৯-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ নারীর কাছে স্বামীর হাতে মার খাওয়া স্বাভাবিক। সহজভাবে বললে দেশের প্রতি চারজন বিবাহিত নারীর একজন স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক মনে করেন। স্বামীর অনুমতি না নিয়ে বাইরে যাওয়া, বাচ্চাদের প্রতি যত্নশীল না হওয়া, স্বামীর সঙ্গে তর্ক করা, যৌন সম্পর্ক করতে অস্বীকৃতি জানানো, খাবার রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা- এই পাঁচটি কারণের অন্তত একটির জন্য ওই নারীরা মার খান। লঘু ভুল করার জন্য এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হন বিবাহিত নারী।

একবিংশ শতকে এসেও নারীর প্রতি এই সহিংসতার ঊর্ধ্বগতিতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান- নারীরা উন্নয়নের সব মানদণ্ডেই পিছিয়ে। আমরা আধুনিক হচ্ছি; সেই সঙ্গে নারীরা নতুন নতুন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে সেসব কাজকে বোঝায়, যার দ্বারা একজন নারীর শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও যৌন ক্ষতি হয়ে থাকে। এমনকি নারীর পারিবারিক বা সামাজিক জীবনে স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে- এ ধরনের কাজের হুমকি নারীর প্রতি সহিংসতার পর্যায়ে পড়ে।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহিংসতার শিকার নারীরা মনে করেন, সহিংসতাকারী তাঁর আপনজন; তাদের ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য কোনো নিরাপদ জায়গা বা আশ্রয়স্থল নাও থাকতে পারে। প্রতিবাদ করলে তাঁর সন্তান এবং তাঁকে সমাজ বা আত্মীয়স্বজন কী চোখে দেখবে। সহিংসতা-সংশ্নিষ্ট সেবা সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান এবং সেবা গ্রহণেও অনীহা।

নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতাই শারীরিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। এসব সহিংসতার মাধ্যমে নারীসহ সংশ্নিষ্ট পরিবারের অনেক ক্ষতি ও খরচ হয়ে থাকে। নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সব খরচই এ ক্ষতির আওতাভুক্ত। এই ক্ষতি-খরচের মধ্যে কিছু আছে সরাসরি দৃশ্যমান। যেমন সহিংসতার শিকার নারীর যাবতীয় চিকিৎসা ও আইনি লড়াইয়ে ব্যয় এবং সন্তানাদি (যদি থাকে) দেখাশোনা। অন্যদিকে অদৃশ্যমান খরচের মধ্যে বিশেষত সময়ের ক্ষতি রয়েছে। সহিংসতার শিকার ও সহিংসতাকারী, তাদের পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং আরও অনেকে ঘটনাপ্রবাহে জড়িয়ে পড়েন। যাঁরাই এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট থাকেন, ওই সময়ে তাঁরা তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না। এর ফলে উপার্জন ব্যাহত হয়। এসব ব্যয় আমরা সরাসরি দেখতে পাই না। কারণ এতে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের পকেট থেকে কোনো অর্থ ব্যয় হয় না, বরং তাঁরা তাঁদের নির্দিষ্ট উপার্জন থেকে বঞ্চিত হন। সহজভাবে এসব ব্যয়কে আমরা সময়ের ক্ষতি বলতে পারি।

যে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর বাস; সেখানে ইতিবাচক পরিবর্তন না এলে নারীর ক্ষমতায়ন স্থায়িত্বশীল হওয়া কঠিন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরায়ত নিয়ম-নীতি এবং বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে এবং নারীর প্রতি মর্যাদাবোধ, আন্তরিক সদিচ্ছা আর জবাবদিহি বৃদ্ধি পেলে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন করা সম্ভব।

সৈয়দা আশরাফিজ জাহারীয়া প্রধান: অ্যাডভাইজার, জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট ভয়েজ ফর গ্লোবাল উইমেন লিডারস, কেয়ার বাংলাদেশ

আরও পড়ুন

×