ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

অর্থনীতি

ব্যাংক খাত নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ কোথায়?

ব্যাংক খাত নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ কোথায়?

মামুন রশীদ

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৬:০০

ব্যাংক খাত নিয়ে অন্যান্য বিকাশমান অর্থনীতি ও দুর্বল সুশাসনের দেশের মতো আমাদেরও সব সময় চিন্তা ও উদ্বেগ ছিল। সেই সঙ্গে নতুন নতুন অর্থায়নের সাফল্যের জন্য বেশ স্বস্তিও ছিল। সাম্প্রতিক কিছু খবরে সেসব স্বস্তির স্থলে ব্যাংক খাত নিয়ে নৈতিক গ্লানি যেন বেড়ে গেছে।

স্বীকার করতেই হবে, সুশাসনের অভাব, বেপরোয়া দুর্নীতি, ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক ও পরিচালকদের হস্তক্ষেপ এবং খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতির কারণেই ব্যাংক খাতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এই খাতে বিদ্যমান দুর্বলতাকে আরও নাজুক করে তুলেছে। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা প্রকাশ্যে চলে আসে। এতে মানুষ নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছে। ঋণ পরিশোধ কমে গেছে। ব্যাংক খাত নিয়ে তাই দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে।

ডলারের সংকট ব্যাংক খাতকে আরও বেশি ভোগাচ্ছে। রেমিট্যান্স, আমদানি-রপ্তানি বেশি থাকলে এসব খাত থেকে ব্যাংকের আয় বাড়ে। কিন্তু এসব খাতের পাশাপাশি ব্যবসা খাতে মন্দা চলছে। ফলে ব্যাংকের আয় কমেছে। ডলারের প্রবাহ কম থাকায় আমদানির এলসি খুলতে পারছে না। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে গিয়ে টাকা চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নিকট অতীত পর্যন্ত ১ হাজার ৭৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বাবদ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তারল্য হ্রাস পাওয়ার এটিও এক কারণ।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাংক খাত নিয়ে নানা ধরনের গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকে এসব গুজবে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ব্যাংক থেকে টাকাও তুলে নিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সামাজিক মাধ্যমের সব তথ্যই ভুয়া। ব্যাংকে তারল্য সংকট নেই। গ্রাহকদের আমানত নিরাপদেই রয়েছে।

অস্বীকারের অবকাশ নেই, দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব। যে কারণে কয়েকটি ব্যাংকে বড় ধরনের জালিয়াতি ঘটেছে। এর সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও শীর্ষ পর্যায়ের ব্যাংকাররা জড়িত। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার দায়ে ৮টি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলমান। তিনটি ব্যাংকের এমডি পলাতক। ২০১২ থেকে ২০১৭ সালে শুধু ১২টি বড় ঋণ জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের কারণে বেড়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। খবর বলছে, এ দুটি গ্রুপ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এ ছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ঋণের প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপিতে পরিণত। ওইসব ঋণের একটি অংশ বিদেশেও পাচার হয়েছে।

আগে থেকেই ঋণ আদায় করতে পারছিল না ব্যাংক। ফলে সেগুলো খেলাপি হচ্ছিল। খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে খেলাপিদের বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। এ সুযোগে ঋণ আদায় না করেও এর বিপরীতে সুদকে আয় খাতে নেওয়া হয়েছে, যা কাগুজে মুনাফা বাড়িয়েছে। কিন্তু নগদ টাকা ব্যাংকের হিসাবে ঢোকেনি। এতে ব্যাংকের হিসাবে ওপরের অংশ স্বাস্থ্যবান দেখাচ্ছে, কিন্তু ভেতরের অংশ ক্রমেই ফাঁপা হয়ে উঠছে, যা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। করোনার কারণে ২০২০ থেকে ২০২১ সাল- এ দুই বছর ঋণ আদায় সম্ভব হয়নি। করোনার পর গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে ঋণ পরিশোধে এখন কিছু ছাড় বহাল রয়েছে। ফলে প্রায় তিন বছর ধরে ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেই যাচ্ছে; কিন্তু আদায় করতে পারছে না। এর একটি অংশ আদায় না হয়ে খেলাপি হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ।

ব্যাংক খাতে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শীর্ষ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হয়নি বা আনা যায়নি। এসব কারণেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপিদের ছাড় দিয়ে আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দার সামান্য একটু ধাক্কা লাগতেই ব্যাংকের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। অনেকেই বারবার বলছেন, খেলাপিদের কোনো ছাড় দেওয়া ঠিক নয়। ছাড় দিতে হবে ভালো গ্রাহকদের। খেলাপি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বরং আগে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংক সংস্কার করাটাও অনেক জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি থাকলে এর সুদ আয় খাতে নেওয়া যায় না। শুধু হিসাব করে আলাদা একটি হিসাবে স্থগিত সুদ হিসেবে রাখতে হয়। খেলাপি ঋণের বিপরীতে এমন স্থগিত সুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের মোট বাজেটের ৩৩ শতাংশ। এই অর্থ দিয়ে চারটি পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব।

খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে রয়েছে আরও ৪৫ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকার ঋণ। এগুলোর কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ শেষ হলেও করা হচ্ছে না। ফলে কিস্তি পরিশোধ না করলে ছয় মাস পরেই এগুলো খেলাপি হয়ে যাবে। তখন এসব ঋণের সুদও আয় খাতে নেওয়া যাবে না, যা এখন নিতে পারছে।

খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণ বেড়ে ৮৮ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর বিপরীতে রাখা আছে ৭৫ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এ অর্থও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক অন্য খাতে ব্যবহার করতে পারছে না। খেলাপি ঋণের ঝুঁকির বিপরীতে ব্যাংককে নিরাপদ রাখতে এ অর্থ আটকে রয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি আছে ১৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে। একই কারণে কমে গেছে মূলধন। গত বছরের জুনে ব্যাংকগুলোয় মূলধন-পর্যাপ্ততা ছিল ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশে। আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এবং আয় খাত থেকে রিজার্ভ তহবিলে অর্থ নিতে পারেনি। যে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে কমেছে মূলধন।

করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে বেশি দাম দিয়ে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে মন্দায় মানুষের আয় কমেছে। ফলে ভোক্তারা দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এখন সঞ্চয় করতে পারছে না। এতে ব্যাংকে সঞ্চয়ের গতি কমে গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সঞ্চয় বেড়েছিল ৯ শতাংশ। চলতি বছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র দশমিক ৭৬ শতাংশ। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ মেটানোর কারণে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হার বেড়েছে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যাংকবহির্ভূত মুদ্রা বেড়েছিল ১০০ কোটি টাকা। চলতি বছরের একই সময়ে বেড়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এদিকে ব্যাংক খাতে আমানত কমছে, কিন্তু ঋণ বেড়েছে ১৬ শতাংশ। প্রচলিত নিয়মে ঋণের চেয়ে বেশি বাড়তে হয় আমানতের প্রবৃদ্ধি। আমানত কমার কারণে ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট হতে পারে আগামী দিনে। সম্ভাব্য এ সংকট কাটাতে আমানত বাড়াতে হবে; ঋণ কমাতে হবে। এদিকে আমানতের সুদের হারের চেয়ে মূল্যস্টম্ফীতির হার বেশি হওয়ায় ব্যাংকে রাখলে টাকা বাড়ার পরিবর্তে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মূল্যস্টম্ফীতির হার ৮ শতাংশের ওপরে। অন্যদিকে ব্যাংকে আমানতের গড় সুদের হার ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের জরুরি চাহিদা মেটাতে মোট আমানতের সাড়ে ৩ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর রাখতে হয়। আগে এটি বেশি ছিল। এখন চাহিদার মধ্যেই থাকে। বেশি থাকে না। একই কারণে নগদ বা বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করে (এসএলআর বা বিধিবদ্ধ আমানত) হিসাবে রাখতে হয় ১৩ শতাংশ। এ খাতে আগে উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত মার্চে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোয় নগদ টাকায় টান পড়ছে। যে কারণে উদ্বৃত্ত তহবিল কমে গেছে। তবে ব্যাংকগুলোয় এখনও সূত্রমতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা। তবে সব ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য নেই। শুধু হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।

ব্যাংকগুলোর গত জুনে ৮৭ দশমিক ২৬ শতাংশ সম্পদের বিপরীতে ঝুঁকি ছিল। এখন তা বেড়ে ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ সম্পদের বিপরীতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে।

ব্যাংকের মূলধন ও সম্পদ থেকে আয় কমেছে। গত বছরের মার্চ-জুন প্রান্তিকে সম্পদ থেকে আয় ছিল শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ। এ বছরের একই সময়ে তা কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে মূলধন থেকে আয় ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ বছরের ওই সময়ে তা কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

সম্পদ থেকে ৭টি ব্যাংক কোনো আয় করতে পারেনি। ১০০ টাকার বিপরীতে ৫ পয়সার কম আয় করেছে ১২টি ব্যাংক। ৫ পয়সার বেশি থেকে ১০ পয়সা পর্যন্ত আয় করেছে ১৬টি ব্যাংক। ১০ পয়সার বেশি থেকে ১ টাকা পর্যন্ত আয় করেছে ২০টি ব্যাংক। ১ টাকার বেশি আয় করেছে ১৭টি ব্যাংক।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মূলধন থেকে আয় ছিল ইতিবাচক। এখন তা নেতিবাচক, ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সম্পদ থেকে আয় ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক হয়েছে। এক বছর আগে খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৩ শতাংশ। আগে ছিল ১৫ শতাংশ।

কষ্ট করে পাঠক যাঁরা এ পর্যন্ত পড়েছেন; নিশ্চয় ভাবছেন, ব্যাংক খাতে সংকটের সমাধান কোথায়? উত্তরে বলব- সংকটের স্বীকৃতি দিয়েই সমাধানের পথে এগোতে হবে। সংস্কার করতে হবে- যে পদ্ধতিতে আমরা ঋণ ঝুঁকি পর্যালোচনা করছি, ঋণ বিতরণ করছি, ঋণ আদায় করছি এমনকি খাতওয়ারি ঋণ দেওয়ার বিষয়েও। ব্যাংক খাতের সাফল্য কিন্তু ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের সুশাসনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। তাই বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি নিশ্চিত না করতে পারলে ব্যাংক খাতেও সুশাসন নিশ্চিতকরণ সম্ভব নয়।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্নেষক

আরও পড়ুন

×