মানবাধিকার দিবস
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবাধিকার অচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা

মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৭:২৪
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র (ইউডিএইচআর) গৃহীত হয়। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর এই দিনটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস রূপে পালিত হচ্ছে। সে হিসাবে এবার ৭৫তম মানবাধিকার দিবস। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে মানুষের অবিভাজ্য ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারের অঙ্গীকার করা হয়েছে। এই অধিকারগুলো বাস্তবায়নে কোনো বলবৎকরণ ব্যবস্থা (এনফোর্সমেন্ট মেকানিজম) রাখা হয়নি। এ জন্য একে 'সফট' আন্তর্জাতিক আইন বলা হয়। তবে ১৯৬৬ সালে গৃহীত ইন্টারন্যাশনাল কভিন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস-আইসিসিপিআর এবং ইন্টারন্যাশনাল কভিন্যান্ট অন ইকোনমিক, সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল রাইটস-আইসিইএসসিআরে বলবৎকরণের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যদিও এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকরী, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল; গণহত্যায় যখন লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছিল; মুজিবনগর সরকার তখন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে। এই ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। তা ছাড়া এ ঘোষণাপত্রে 'আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার' প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার মাধ্যমে বাংলাদেশে 'আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার' প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা দীর্ঘ সময়ের জন্য রুদ্ধ রাখা হয়। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে সামরিক স্বৈরশাসকরা ক্ষমতাকে জায়েজ করতে রাষ্ট্রধর্ম ঢুকিয়ে দেন। সাম্যের বদলে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। মানবিক মর্যাদা হয় ভূলুণ্ঠিত। সামাজিক ন্যায়বিচারের জায়গা হয় ভাগাড়ে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে নেমে আসে মানবাধিকারবিরোধী দীর্ঘ তমসা। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্র পুনর্বহাল হলো বটে, কিন্তু রাজনীতি থেকে ধর্মের অপব্যবহার দূর করা গেল না। এখন নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুরা শঙ্কিত বোধ করে।
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অবিভাজ্যরূপে ছিল। পরে ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপে ইউডিএইচআরের অধিকারগুলোকে আইসিসিপিআর ও আইসিইএসপিআর নামে দুটি আলাদা দলিলে ভাগ করা হয়। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই বিভাজনকে স্বীকার করেনি। আদি ইউডিএইচআরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা ঘোষণা করেছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অমোঘ বাণী।
গণতন্ত্রের জন্য মানবাধিকার দরকার। মানবাধিকারের জন্য গণতন্ত্র দরকার। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ব্যতীত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়- এটি চিরন্তন সত্য। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের নাগরিকরা সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে থাকায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল থেকে গেছে। অন্যদিকে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক সমাজ না থাকলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অর্থাৎ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা ও অন্যান্য আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারও সমভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়। আদিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল এই অবিভাজ্য ও অবিচ্ছেদ্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তার সংহতির স্বার্থে প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ ধারণ, লালন, প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।
উল্লিখিত কারণে বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যতিরেকে আমরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। সে জন্য বাংলাদেশকে তার সব উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। তবে মানবাধিকারের নামে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ কোনো মর্যাদাবান বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় খবর বেরুচ্ছে- বিদেশি কূটনৈতিক মহল বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছে। এ রকম আচরণ কূটনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১-এর অনুচ্ছেদ ৩-এ কূটনৈতিক মিশনের পাঁচটি কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে :ক) স্বাগতিক রাষ্ট্রে নিজ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা, খ) আন্তর্জাতিক আইনের পরিসীমার ভেতরে থেকে স্বাগতিক রাষ্ট্রে নিজ রাষ্ট্র এবং নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা, গ) স্বাগতিক দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা, ঘ) আইনের আওতার মধ্যে থেকে স্বাগতিক দেশের পরিস্থিতি এবং উন্নয়ন পর্যালোচনা করে নিজ দেশকে তা অবহিত করা এবং ঙ) স্বাগতিক দেশের সঙ্গে নিজ দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলাটা স্বীকৃত পাঁচটি কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে না। এ ছাড়া ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনসের বাইরেও এ সংক্রান্ত প্রচলিত (কাস্টমারি) আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন বিধান রয়েছে। এর অন্যতম হলো- কোনো দূত স্বাগতিক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। বিদেশি কূটনৈতিক মহলের সাম্প্রতিক তৎপরতাকে কেউ কেউ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে সাব্যস্ত করছেন।
বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়, কারও সঙ্গে বৈরিতা চায় না। এই নীতি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি। সম্প্রতি এই নীতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে স্বীকৃত হয়েছে। এই পরিষদের ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব ডায়ালগ অ্যাজ অ্যা গ্যারান্টি অব পিস, ২০২৩ শীর্ষক প্রস্তাবের চতুর্দশ অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ গঠিত হলেও এই শতকে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ এশিয়ায় অশান্তি ছড়িয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপেও যুদ্ধের আঁচ লেগেছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকে আধিপত্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করে বঙ্গবন্ধুর শান্তির নীতি গ্রহণ করা উচিত। তা ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবাইকে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতি বিশ্ব নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
পরিশেষে বলতে হয়, বিজয়ের মাসে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করতে হলে সব অংশীজনকে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে। সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়াটা দরকার, তেমনি সরকারের সাফল্যের স্বীকৃতিও থাকা প্রয়োজন। একইভাবে শুধু নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নয়; আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারসহ সব ধরনের মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। এসব অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করতে হবে। পরিবেশগত অধিকারও মানবাধিকার; একেকটি জনগোষ্ঠীর অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, উন্নত রাষ্ট্রগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটা বাংলাদেশ।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান: সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
- বিষয় :
- মানবাধিকার দিবস
- মিজানুর রহমান