অন্যদৃষ্টি
ওয়েলকাম টু মুজিবস ল্যান্ড

অজিত কুমার সরকার
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চিকিৎসার জন্য দিল্লির উদ্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন শেষ করে বাংলাদেশ বিমানে ওঠার জন্য অপেক্ষমাণ রুমে বসে আছি। সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল পোস্টারের আদলে বাঁধাই করা ফ্রেমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবিসহ লেখা- 'ওয়েলকাম টু মুজিবস ল্যান্ড'। বাংলায় বললে- মুজিবের দেশে স্বাগত। এর মধ্যে নিহিত বার্তা জানিয়ে দেয়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ সমার্থক শব্দ।
বিমানবন্দরের নানা জায়গায় টাঙানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এবং পিতা-কন্যার অসাধারণ ছবিসহ আরও কিছু ছবি। নিচে রয়েছে মুজিব কর্নার, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ড দলিলসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন-কর্ম, আন্দোলন-সংগ্রামের ওপর লেখা বেশ কিছু বই। জানা গেল, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এই অসাধারণ কাজটি করেছে- যা আগে ছিল না।
প্রায়ই লক্ষ্য করি, বিভিন্ন লেখনী, বক্তৃতা-বিবৃতি, পোস্টারে বঙ্গবন্ধু উপাধির অতি ব্যবহারে শেখ মুজিবুর রহমান বা শেখ মুজিব নামটি অনুচ্চারিত থাকে। যেমন ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে প্রকাশিত 'বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ:রাজনীতির মহাকাব্য' বইয়ের একটি ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে ২৬টি বাক্যের বিশ্নেষণ করেছেন দেশের ২৬ জন খ্যাতিমান লেখক। এর অনুবাদ করে প্রকাশিত হয় 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবস সেভেনথ মার্চ স্পিচ:এপিক অব পলিটিকস' শীর্ষক গ্রন্থ।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের পরিকল্পনায় দুটি গ্রন্থেরই সম্পাদনার সঙ্গে আমি, ঢাবির প্রাক্তন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফকরুল আলম, সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান যুক্ত ছিলাম। মুখবন্ধ লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইংরেজি ভার্সনে বঙ্গবন্ধু শব্দের সঙ্গে 'শেখ মুজিব' যুক্ত করে গ্রন্থটির নামকরণ করেন তিনি। মুখবন্ধের যে অংশে প্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, তার সঙ্গে শেখ মুজিব অথবা শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৫ বছরের জীবন ও কর্মের ওপর যদি আলোকপাত করি- দেখা যাবে তিনি খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতায় উত্তীর্ণ হয়েছেন কর্মগুণ, সাহস ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। পিতা-মাতা ডাকতেন খোকা। সাধারণ মানুষ ডাকতেন শেখ মুজিব বা শ্যাখ সাহেব। সহকর্মীরা ডাকতেন মুজিব ভাই। আবার কেউ কেউ বলতেন লিডার। বঙ্গবন্ধু নিজে 'মুজিব ভাই' সম্বোধনটি খুব ভালোবাসতেন। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক এ বি এম মূসার 'মুজিব ভাই' গ্রন্থের ভূমিকায় সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
বঙ্গবন্ধু উপাধি ছাড়াও তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত নানা বিশেষণ, যেমন- স্বাধীনতার স্থপতি, একটি জাতিসত্তার প্রবক্তা, স্বাধীন দেশের রূপকার, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ইত্যাদি। এসবই তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের অর্জন। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন। তবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিরোনামটি দেয় বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকা- 'পোয়েট অব পলিটিকস' (১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যা)। এ কথা অনস্বীকার্য, বঙ্গবন্ধু উপাধি উচ্চারণের সঙ্গে একজন ব্যক্তিকেই বোঝায়। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। যেমন নেতাজি বলতে সুভাষ চন্দ্র বোসকে বোঝায়। একজন অগ্রজ প্রজন্মের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার স্থপতি, একটি জাতিসত্তার প্রবক্তা, স্বাধীন দেশের রূপকার, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ইত্যাদি বলা হলে তিনি আর কেউ নন- শেখ মুজিব। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের কেউ যখন কোনো লেখনী পড়ে বা বক্তৃতায় বারবার এসব উপাধি ও বিশেষণ শোনে; তখন যদি 'শেখ মুজিব' নামটি এসব উপাধি বা বিশেষণের একবারও উচ্চারিত না হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুই যে শেখ মুজিব, তা কীভাবে বুঝবে? তাই বঙ্গবন্ধু উপাধির সঙ্গে আমরা যেন যেখানে সমীচীন সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান বা শেখ মুজিব কথাটি লিখতে বা বলতে ভুলে না যাই।
অজিত কুমার সরকার: সিনিয়র সাংবাদিক
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- অজিত কুমার সরকার