ফিরে দেখা
অর্থনীতিতে আসছে আরও চ্যালেঞ্জ

মামুন রশীদ
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০
কভিড থেকে আপাত মুক্তি নিয়ে ২০২২ সালটি মোটামুটি ভালোভাবে শুরু হলেও ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিত্যপণ্য আর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতি নিয়ে শুরু হয় নানা দুশ্চিন্তা। পরবর্তী সময়ে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও তারল্যের সংকট, বিদেশে পুঁজি পাচার, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, রিজার্ভে টান পড়া নিয়ে বছরজুড়েই ছিল আলাপ-আলোচনা। রিজার্ভের হিসাব নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রশ্ন তোলা নিয়েও জোর বিতর্ক ছিল। বছরের শেষদিকে আবার কিছু ব্যাংকে ঋণ অনিয়মের অভিযোগ আর ব্যাংক খাতে টাকা নেই- এমন গুজব অনেকের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন যুক্ত হয়েছে অনিশ্চয়তা। নির্বাচন, প্রবাসী আয়ে টান ও অপচয়-দুর্নীতি নিয়ে শঙ্কায় আগামীতে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে বলে অনেকের ধারণা।
২০২২ বছরজুড়েই চালের দাম ছিল বেশ চড়া। এমনকি ভোজ্যতেল, চিনি, লবণ আর পেঁয়াজের দাম নিয়েও ছিল বাজার গরম। ফলে মূল্যস্টম্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অন্যদিকে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বেড়ে যায়। এর প্রভাবে বৃদ্ধি পায় পরিবহন ভাড়া। আরেক দফা দাম বাড়ে নিত্যপণ্যসহ প্রায় সবকিছুরই।
অনেকেই বলেছেন, বছরটি ছিল অনিশ্চয়তার। তবে এটা ছিল বিশ্বব্যাপীই। ২০২০ সালে কভিড সংক্রমণের মধ্য দিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা এখন আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কখনোই খুব ভালো ছিল না। এ খাতে নজরদারি ছিল দুর্বল; খেলাপি ঋণের হার ছিল উচ্চ; সরকারি ব্যাংকের ছিল প্রায় নিয়মিত মূলধন ঘাটতি। সেই সঙ্গে সাম্প্র্রতিক যোগ হয়েছে বিশেষ কিছু ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে নেওয়া ঋণ।
প্রায় বছরজুড়েই ডলার নিয়ে বেশ সংকট ছিল। ঋণপত্র খোলা আর সময়মতো আমদানি দায় সম্পন্ন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হুন্ডি বেড়ে যাওয়াতে প্রবাসী আয়ে বেশ টান পড়ে। সম্প্রতি নানামুখী উদ্যোগে কিছুটা হলেও স্থিতিশীলতা ফিরছে। খেলাপি ঋণ আদায়েও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। ব্যাংকে টাকা নেই- এমন গুজবও কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সাধারণ মানুষের আস্থাও কিছুটা বেড়েছে। তারপরও ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ছিল প্রায় বছরজুড়েই। তবে আগামীতে অর্থনীতির যে উন্নতি আশা করা হচ্ছে, তা ঘটবেই- এমন আশা করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশ বিশ্বের বাইরে নয়। আমাদের তাই সামনের দিনে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগোতে হবে। সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্টম্ফীতির চাপের মধ্যেও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে মানুষের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। আমরা দেখেছি, বছরের শুরুর দিকে দেশে মার্কিন ডলারের সংকট দেখা দেয়। চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৪০০ কোটি (৩৪ বিলিয়ন) ডলারের আশপাশে ওঠানামা করছে। এ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ কয়েকটি তহবিলে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার। এ বিনিয়োগ করা অর্থ বাদ দিলে রিজার্ভ থাকে ২ হাজার ৬০০ কোটি (২৬ বিলিয়ন) ডলার, যা দিয়ে বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত আমদানির মধ্যে সাড়ে চার মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব। অর্থাৎ খরচ করার মতো রিজার্ভ এখন ২৬ বিলিয়ন ডলার। এর আগে সরকারের আমদানি দায় পরিশোধে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রির পরিমাণ ৬০৫ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বরং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৯৩ কোটি ডলার ক্রয় করেছিল। ডলার সংকট এড়াতে আমদানি ব্যয়ের চাপ কমাতে বিলাসী পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এতে উৎপাদনশীল খাতও দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যায় পড়তে পারে বলে কারও কারও আশঙ্কা।
দেশের খোলাবাজারেও ডলার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগে পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ৪২টি মানি এক্সচেঞ্জকে কারণ দর্শানো হয়েছে। আরও ৯টি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের সংকটকে পুঁজি করে, এমনকি অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ১২ ব্যাংক নিয়ে। অভিযোগ- প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার মজুত করে বড় অঙ্কের মুনাফা করে তারা। এসব অভিযোগের কারণে ব্যাংকগুলোর এমডিদের কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অব্যাহত হ্রাস পাওয়ার প্রক্রিয়াকে সরকার স্বাভাবিক বললেও এ নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হয়। একটি পক্ষ রিজার্ভে টান পড়ায় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হতে পারে বলে বিভিন্ন সময় আশঙ্কা প্রকাশ করে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসলে কত? রিজার্ভ গেল কোথায়? এসব প্রশ্নও তোলা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। এমন প্রেক্ষাপটে আইএমএফ বাংলাদেশের রিজার্ভ সংরক্ষণের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রিজার্ভের হিসাব রাখাসহ বেশ কিছু সংস্কারেরও পরামর্শ দেয় তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাতে সায় দিয়েছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। সেই হিসাবে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও (এনবিএফআই) ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা।
কভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধে বেশ কয়েক দফা 'বিশেষ ছাড়' দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার কভিডের পাশাপাশি বন্যা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবারও ছাড় দেওয়া হয়। ছাড়ের মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। ফলে ঋণের কিস্তি পুরোপুরি পরিশোধ না করেও খেলাপি হওয়া থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন অনেকে। তবুও কমছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। বরং আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বলা চলে, উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে আটটি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার বেশি।
ওদিকে ঋণ জালিয়াতির কারণে তারল্য সংকট দেখা দেয় ইসলামী ব্যাংকগুলোতে। গ্রাহকরা আস্থা সংকটের কারণে টাকা তুলে নিতে থাকেন। চলমান তারল্য সংকট কাটাতে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে তারল্য সহায়তা হিসেবে নগদ টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে গত ১২ ডিসেম্বর দু'জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। পরিণতিতে ৭৫৫ কোটি (৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসেবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৩ টাকা ৮৫ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ ৭৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা।
অনেকেই বলছেন, সুশাসন বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর না হলে ব্যাংক খাতে কোনোদিনই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। খেলাপি ঋণ কমাতে বা আদায়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এ খাতের খেলাপি ঋণ দিন দিন বরং আরও বাড়বে। ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতিও বন্ধ করতে হবে। সুদের হার এবং বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনায় আরও বাজারমুখী হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আধুনিকীকরণ এবং গোটা ব্যাংকিং খাতের সংস্কার নিয়েও জোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে সমস্যা যে অনেক দীর্ঘায়িত হবে- সন্দেহ নেই। শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের মধ্যে আটকে থাকলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মুক্তি মিলবে না। উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের জীবনেও স্বস্তি আসবে না।
মামুন রশীদ :অর্থনীতি বিশ্নেষক
- বিষয় :
- ফিরে দেখা
- মামুন রশীদ