সরস্বতী পূজা
সত্য ও সুন্দরের আরাধনা

নিম চন্দ্র ভৌমিক
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৯:২৩
সরস্বতী হচ্ছে জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী। জ্ঞান ও বিদ্যার জোরেই সভ্যতা এগিয়ে চলছে। জ্ঞানচর্চা তথা গবেষণার মাধ্যমে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। যে দেশ জ্ঞানচর্চায় অগ্রসর হচ্ছে, তারাই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এগিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সরস্বতী পূজার গুরুত্ব অনেক। একসময় এ পূজা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিমা স্থাপন করে পূজায় অংশ নিতেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও পূজা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পূজার দিন সকালে ভক্তের ঢল নামে। উপাসনার মাধ্যমে সত্য উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে এদিন তাঁরা বিদ্যা দেবীর সামনে উপস্থিত হন। তবে এখন এই পূজা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাসগৃহে সীমাবদ্ধ নেই। এর পরিসর বেড়েছে। শুধু ঢাকা মহানগরীর কথা যদি বলি, তাহলে দেখা যায়- হাইকোর্ট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব থেকে শুরু করে পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজা উদযাপিত হচ্ছে।
আসলে বিদ্যা বলতে একাডেমিক জ্ঞানকেই বোঝায় না; পেশাজীবীদেরও প্রতিনিয়ত জ্ঞান অর্জন করতে হয়। নতুন নতুন কলাকৌশল জানতে হয়। তা না হলে আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকা কঠিন। এ কারণে পেশাজীবীরাও সরস্বতী দেবীর গুরুত্ব অনুধাবন করে পূজার আয়োজন করে যাচ্ছেন। এদিন আমরা দেবী সরস্বতীকে স্মরণ করি। তাঁর কাছে প্রার্থনা করি- কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠে আমরা যেন জ্ঞানের সঠিক সন্ধান পাই। সত্য ও সুন্দরকে গ্রহণ এবং অসত্য ও কুসংস্কারমুক্ত থাকার শপথ করি।
স্বাধীন বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার সংবিধানে রয়েছে। তারপরও মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হতে হয় সংখ্যালঘুদের। মাঝে মাঝে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষার্থীও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন বলে সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। হলি আর্টিসান হামলায় এ রকম কারও কারও নাম আমরা দেখেছি। প্রগতিশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালীন কোনো শিক্ষার্থীর উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার খবর আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের। তাই সরস্বতী পূজায় মায়ের কাছে প্রার্থনা থাকবে- আর কোনো শিক্ষার্থী যেন ভুল পথে পা না বাড়ান। সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাবোধ জাগ্রত হোক।
মাঝেমধ্যে শিক্ষার্থীদের দুই পক্ষের বিবাদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বন্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। এসব সংঘাত কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। এবারের সরস্বতী পূজায় আমাদের প্রত্যাশা- এ ধরনের সংঘাতের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার দেশ গড়তে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সব ধর্মের মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
সব ধর্মেই জ্ঞানার্জনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সত্য অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করতে বলা হয়েছে। তাই সরস্বতী পূজা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় এবারের উৎসব ঘিরে আমাদের আলাদা আগ্রহ রয়েছে। মাঝখানে দুই বছর করোনা মহামারির কারণে সব ধরনের উৎসব বন্ধ ছিল। বিধিনিষেধের কারণে সশরীরে উপস্থিত হয়ে পাবলিক অনুষ্ঠান করা যায়নি। এবার সেই বিধিনিষেধ নেই। তাই শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মায়ের আরাধনা করবেন।
ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে। সম্প্রতি পেশাজীবীদের আয়োজনেও বড় পরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের এতে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। পূজার পরের দিনটি শীতলাষষ্ঠী নামে পরিচিত।
সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতীসদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। উনিশ শতকে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্নেট, দোয়াত-কলমে সরস্বতী পূজা করতেন। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিশ শতকেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন।
শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালে সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়। সরস্বতী পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারে হয়। তবে এ পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যেমন- অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজার জন্য গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল ভক্ষণ করে না। পূজার দিন কিছু লেখাও নিষিদ্ধ। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত। এই দিন ছোটদের হাতেখড়ি দিয়ে পাঠ্যজীবন শুরু হয়। পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়। পূজার পরদিন আবার চিড়ে-দই মিশ্রিত দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক: সভাপতি, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও সাবেক রাষ্ট্রদূত
- বিষয় :
- সরস্বতী পূজা
- নিম চন্দ্র ভৌমিক