ফলভিত্তিক শিক্ষা যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

মো. শফিকুল ইসলাম ও গাজী মো. সাখাওয়াত হোসেন
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:৩২
ফলভিত্তিক শিক্ষা বা আউটকাম বেজড এডুকেশন একটি প্রক্রিয়া, যা কোর্স শেষে ছাত্ররা কী অর্জন বা শিখতে সক্ষম হলো, সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে। ফলভিত্তিক শিক্ষা একটি বহুবিভাগীয় পদ্ধতি, যা শিক্ষার্থীদের স্বভাব, অনুভূতি এবং মনোভাবের ওপর জোর দিয়ে থাকে। ফলভিত্তিক শিক্ষা একটি উন্নয়নমূলক পদ্ধতি, যা শিখন মানদণ্ডভিত্তিক এবং গঠনমূলক মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যার প্রভাব দুই বা তার বেশি বছর পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। কিন্তু সিলেবাস সাধারণত একটি বছরকেন্দ্রিক গুরুত্বদিয়ে থাকে।
শিক্ষার্থীরা যেন তাদের ভেতরের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু আবিস্কার করতে পারে। এটাই হলো ফলভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। এ ছাড়া ফল ভিত্তিতে এক ব্যক্তিকে অন্য থেকে আলাদা করা যায়। এটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষার মডেল, যা শিক্ষকদের একটি বিষয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাথায় রেখে পাঠদান এবং মূল্যায়নের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে। এটা সহজ করার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন- বেঞ্জামিন ব্লুম (১৯১৩-১৯৯৯), একজন আমেরিকান শিক্ষাগত মনোবিজ্ঞানী, যিনি শেখার স্তরের একটি শ্রেণিবিভাগ তৈরি করেছিলেন, যা এখন ব্লুমের শ্রেণিবিন্যাস নামে পরিচিত। সহজ কথায়, ব্লুমের শ্রেণিবিন্যাস হলো একটি শিক্ষণ পদ্ধতি, যা ছয়টি প্রক্রিয়া বা বিষয়ের একটি অনুক্রমিক বিন্যাস। প্রক্রিয়াগুলো হলো- মনে রাখা, বোঝা, প্রয়োগ,বিশ্নেষণ, মূল্যায়ন, সৃষ্টি করা ইত্যাদি। ফলভিত্তিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর জন্য সফলতার অন্তর্নিহিত দর্শনকে অবহিত করে। ফলভিত্তিক শিক্ষা একটি প্যারাডাইম শিফট, যেখানে পুরোনো পদ্ধতি দ্বারা জানানো হয় আমরা ইনপুট-ভিত্তিক কী করছি এবং নতুন পদ্ধতি হলো, আমাদের শিক্ষার্থীরা কী হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সব বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদত্ত ফলভিত্তিক শিক্ষা টেমপ্লেটের ভিত্তিতে তাদের স্নাতক পাঠ্যক্রম সংশোধন করতে বলেছে। দীর্ঘ অনুশীলন করা ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা থেকে কেন এই অউটকাম বেজড এডুকেশন সিস্টেম স্থানান্তরিত হচ্ছে? কারণ, এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শুধু পড়াশোনা শেখাবে না, সঙ্গে সঙ্গে তার পরবর্তী লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করবে। আউটকাম বেজড এডুকেশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, ঐতিহ্যগত শিক্ষার দুর্বলতা দূর করে একটি আধুনিক পদ্ধতি সৃষ্টি করা। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রয়োজন সৃজনশীল, উচ্চ-দক্ষ, নমনীয়, উদ্ভাবনী, সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট, যারা আজকের পরিবর্তিত কাজের পরিবেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম। যাদের কেউ চাকরি করবে বা কেউ উদ্যোক্তা হবে। যার মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হবে।
একটি ছাত্রকেন্দ্রিক পদ্ধতি হিসেবে বছরের পর বছর ধরে ফলভিত্তিক শিক্ষা বিশ্বের অনেক দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। যেমন ২০০৫ সালে হংকং তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ফলভিত্তিক পদ্ধতি কার্যকর করে। মালয়েশিয়া ২০০৮ সালে তাদের সব পাবলিক স্কুল সিস্টেমে ফলভিত্তিক শিক্ষা প্রয়োগ করে।
ফলভিত্তিক শিক্ষা স্পষ্টভাবে একটি শিক্ষা ব্যবস্থায় সবকিছুকে সংগঠিত করে, যা সব শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতার জন্য অপরিহার্য। এই পদ্ধতিটি নীতি, পাঠ্যক্রম এবং মূল্যায়নকে পূর্বনির্ধারিত শিক্ষার ফলের পরিপ্রেক্ষিতে গঠন করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ওবিই বিবেচনা করা শুরু করেছে। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে, সব অনুষদ বা বিভাগের (ব্যবসায় শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, সামাজিক এবং মানবিক) জন্য ফলভিত্তিক শিক্ষা প্রয়োজন। যদিও শুরুর দিকে এটি বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হতে পারে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এটি কার্যকর করতে হবে। বাংলাদেশে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষার্থী এবং ৩০ হাজারের বেশি শিক্ষকসহ ১৫০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ফলভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে পারলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হবে। একটি প্যারাডাইম শিফট হিসেবে নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য এ শিক্ষা ব্যবস্থায় সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে স্বাগতম। শিক্ষা ব্যবস্থায় যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে শিখন ও শিক্ষণ পদ্ধতিতে পরিবর্তনের জন্য ইউজিসিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি অনেক কিছু; কিন্তু আউটকামের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। শিক্ষার্থীদের আউটকাম ভালো না হলে শিক্ষকদের কোনো সার্থকতা থাকে না। তাই আমাদের শিক্ষকদের কোর্স পড়ানোর সময় শিক্ষা ব্যবস্থায় আউটকাম-ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে লেকচার দিতে হবে। যার সুফল পাবে দেশ ও জাতি, ফলভিত্তিক প্রকৃতপক্ষে একটি ভালো ধারণা যদি সঠিকভাবে বোঝা এবং অনুশীলন করা যায়।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এবং গাজী মো. সাখাওয়াত হোসেন: সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ, বরিশাল