প্রযুক্তি
স্মার্ট ভিলেজ ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন

অজিত কুমার সরকার
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:৩৩
২০১১ সালে জার্মানির হ্যানোভার মেলায় 'ইন্ডাস্ট্রি ফোর ডট শূন্য'-এর আনুষ্ঠানিক উপস্থাপন করা হয়। এর ঠিক পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালের ২৮-২৯ জুন ওসাকায় অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে জাপান 'সোসাইটি ফাইভ ডট শূন্য' ধারণা উপস্থাপন করে। সেই জাপান সরকারের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহযোগিতায় বর্তমান সরকার 'স্মার্ট বাংলাদেশ :আইসিটি ২০৪১ মাস্টারপ্ল্যান' প্রণয়ন করছে। বোঝাই যায়, বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরা সুপার স্মার্ট সোসাইটির ধারণাকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ মাস্টারপ্ল্যানের চার স্তম্ভে তাই স্থান পেয়েছে স্মার্ট সোসাইটি। অর্থাৎ ডিজিটাল সংস্কৃতি বিকাশের মাধ্যমে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা হচ্ছে। এ জন্য গ্রাম পর্যন্ত সুপরিকল্পিত প্রযুক্তিনির্ভর নতুন নতুন কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। সরকারের এসব কার্যক্রমের একটি হলো গ্রামগুলোকে 'স্মার্ট ডিজিটাল ভিলেজ'-এ রূপান্তর। এ পরিকল্পনা অনুসারে ২০৪১ সাল নাগাদ অন্তত ২০ হাজার গ্রামকে স্মার্ট ডিজিটাল ভিলেজে পরিণত করা হচ্ছে। এ নিবন্ধের আলোচনার বিষয় এই স্মার্ট ডিজিটাল ভিলেজ ঘিরে।
কেমন হবে এসব স্মার্ট ডিজিটাল ভিলেজ? এ পর্যন্ত যে ধারণা পেয়েছি তা অনেকটা এরূপ- গ্রামেই থাকছে ডিজিটাল বুথ, ডিজিটাল সেন্টার, ইন্টারনেট সংযোগ। এর সঙ্গে থাকছে স্মার্ট ডিভাইস আর কৃষিকাজের জন্য ড্রোনসহ অগ্রসর প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ। উন্নত দেশগুলোতে বড় ও মাঝারি আকারের খামারগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে প্রিসিসন (যাথার্থ্য) কৃষির অনুশীলন করছে, যা সেন্সর, ক্যামেরা, ড্রোন এবং অন্যান্য ডাটা ক্যাপচার পদ্ধতি ব্যবহার করে বাস্তব সময়ে মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ও আলোর মতো ফসলের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছে। সফটওয়্যার স্যুট তথ্য বিশ্নেষণ করে এবং স্মার্ট সরঞ্জাম সঠিক পরিমাণে সার বা পানি ব্যবহারের তথ্য ও পরামর্শ দেয়। উন্নত দেশের আদলে আলোচ্য প্রিসিসন কৃষির অনুশীলন সরকারের স্মার্ট ডিজিটাল ভিলেজের কার্যক্রমেরও অংশ।
'ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন' প্রকল্পের আওতায় স্মার্ট ডিজিটাল ভিলেজ কম্পোনেন্টকে ফেজ ১, ২, ৩- এ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর আওতায় ২০৪১ সালের মধ্যে ২০ লাখ কৃষককে প্রশিক্ষণ এবং ২০ লাখ ডিভাইস দেওয়া হচ্ছে। একই সময়ে সাড়ে তিন লাখ উদ্যোক্তাকে স্মার্ট ফার্মিংয়ের আওতায় আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ফেজ ১-এর আওতায় ২০১৮ সালে সীমিত পরিসরে কৃষকদের কিছু ডিভাইস দিয়ে পাইলটিংও করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১০টি ডিজিটাল ভিলেজ সেন্টার (ডিভিসি) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটির পাইলটিং শুরু হচ্ছে নাটোরের সিংড়া উপজেলার তেলিগ্রাম দিয়ে। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় আরও ৬০টি ডিভিসি স্থাপন করা হচ্ছে।
এর পাশাপাশি আরেকটি উদ্যোগ লক্ষণীয়। 'গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ব্যাংক ও আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসতে দেশের ৯০ হাজার গ্রামে চালু করা হচ্ছে 'ভিলেজ ডিজিটাল বুথ'। এই বুথের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ সব ধরনের লেনদেন সুবিধা পাবে। শিগগিরই ভিলেজ ডিজিটাল বুথ স্থাপনের পাইলটিং করা হচ্ছে মানিকগঞ্জের ৫০টি গ্রামে। এটি স্থাপনে এটুআইর পেমেন্ট এগ্রিগেটর প্ল্যাটফর্ম 'একপে' এবং জয়তুন বিজনেস সলিউশন একসঙ্গে কাজ করবে।' (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৮ জানুয়ারি ২২) পাইলটিংয়ের পর গ্রামভিত্তিক আলোচ্য উদ্যোগগুলোর সফল বাস্তবায়ন গ্রামের মানুষের জন্য আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে- এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অন্যতম লক্ষ্য হতে হবে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। এটি ঠিক, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানোসহ সরকারের নানা উদ্যোগে দেশে দরিদ্র মানুষের হার কমেছে। বৈশ্বিক করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু না হলে দেশে দরিদ্র মানুষের হার আরও কমত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।দেশের দরিদ্র মানুষের অধিকাংশের বাস গ্রামে এবং গ্রামে বসবাসকারী তরুণরা কর্মসংস্থানের জন্য ছোটেন শহরে। এমন চিন্তা থেকে ২০১৮ সালে 'আমার গ্রাম, আমার শহর' ধারণা সামনে আনা হয়। তবে এর অনেক আগে থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বটম আপ অ্যাপ্রোচ পদ্ধতি অনুসরণ করে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে লাস্ট অ্যান্ড কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে গ্রামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে স্মার্ট সোসাইটি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হিসেবে স্মার্ট ডিজিটাল ভিলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ। এসব উদ্যোগের ফলে গ্রামের মানুষের জন্য সম্ভাবনা ও সুযোগ দুই-ই সৃষ্টি হবে।
মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে তাকে কাজে লাগিয়ে জীবনের উন্নতির পথ তারাই করে নেয়। সেই সুযোগ সৃষ্টিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। একটি উদাহরণ দিলে তা স্পষ্ট হবে। সাম্প্রতিককালে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মসংস্থানের জন্য একটি কার্যকর মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয় চীনের তাওবাও ভিলেজ কর্মসূচিকে। সরকার আইসিটি সুবিধার সম্প্রসারণ করে গ্রামে। এ সুবিধাকে কাজে লাগাতে এগিয়ে আসে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ই-কমার্স জায়ান্ট চীনের আলিবাবা। ২০০৯ সালে জিয়াংশু প্রদেশের ডংফেং গ্রামের এক হাজার গরিব পরিবারকে তাওবাও ই-কমার্স মার্কেটপ্লেসে যুক্ত করে তাওবাও ভিলেজ কর্মসূচির পাইলটিং করে। 'চায়না তাওবাও ভিলেজ রিপোর্ট ২০২০' বলছে, তাওবাও ই-কমার্স মার্কেটপ্লেসে গ্রামের সংখ্যা ৫ হাজার ৪২৫ এবং শহরের সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৬। ২০১৮ সালে ১৯৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য (যার অধিকাংশই গ্রামে উৎপাদিত যেমন- আসবাব, হস্তশিল্প, কৃষিপণ্য) বিক্রি হয়; বছরভিত্তিক বৃদ্ধির হার ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ।
তাওবাও কর্মসূচির বিশেষত্ব হলো, গ্রামগুলোকে ই-কমার্সের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করে একদিকে যেমন গ্রামীণ দারিদ্র্য দূর করা হচ্ছে, অপরদিকে যুব সম্প্রদায়কে গ্রামেই ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে। একটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সুপরিকল্পিত কার্যক্রম কীভাবে গ্রামীণ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করছে, তাওবাও ভিলেজ মডেল তার প্রমাণ। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া এ মডেল ব্যবহারে আগ্রহ দেখিয়েছে। বলা বাহুল্য, স্মার্ট ডিজিটাল ভিলেজ প্রতিষ্ঠায় যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, তা গ্রামে প্রিসিসন কৃষির পাশাপাশি ই-কমার্সেরও ব্যাপক প্রসার ঘটাতে পারে। এ জন্য বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।
আশার কথা, সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা উদীয়মান বা অগ্রসর প্রযুক্তির উন্নয়ন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সে আলোকে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করছেন।
অজিত কুমার সরকার: সিনিয়র সাংবাদিক
- বিষয় :
- প্রযুক্তি
- অজিত কুমার সরকার