ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

ব্যাংক খাত

শুধু আইন সংশোধনে সমস্যা মিটবে না

শুধু আইন সংশোধনে সমস্যা মিটবে না

মামুন রশীদ

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৩ | ২৩:৪৬

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা কী– জিজ্ঞেস করলে, বেশিরভাগেরই উত্তর হয়তো হবে– মন্দ ঋণ। কেউ হয়তো বলবেন, অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব বা মালিকপক্ষের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ বা দুর্বল দেখভাল সংস্থার কারণে জবাবদিহির অভাব। গুটিকয়েক হয়তো বলবেন, বহুবিধ সেবাপণ্যের অভাব। এক-দু’জনের মতে হয়তো অতি কম প্রযুক্তির ব্যবহার বা মানবসম্পদের দক্ষতার অভাব। তবে ব্যাংকে একই পরিবার থেকে তিন বা চারজন বোর্ড সদস্য যে প্রধান সমস্যা নয়– এটি প্রায় সবাই স্বীকার করবেন। কেউ হয়তো মুচকি হেসে বলবেন, প্রতিটি ব্যাংকই যে এক-দুটি পরিবার বা ব্যক্তির দাপটে চলে।

যা হোক, সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। গত ৩২ বছরে আইনটি সংশোধন হয়েছে ৭ বার। এর মধ্যে ব্যাংক মালিকদের চাপে এক পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে সর্বশেষ সংশোধন হয় ২০১৮ সালে। 

খসড়ায় ব্যাংক মালিকদের ঠিকই খুশি রেখেছে সরকার। পরিচালকদের সংখ্যায় সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে মাত্র। বর্তমানে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারেন ৪ জন এবং টানা ৯ বছর তাঁরা থাকতে পারেন। সংশোধিত খসড়ায় টানা ৯ বছর পর্ষদে থাকার সুযোগ কমানোর প্রস্তাব নেই। তবে একই পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারবেন চারজনের বদলে তিনজন।

এবারের সংশোধনের খসড়ায় নাকি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা অনেকটাই অসুবিধায় পড়বেন। কারণ খসড়ায় প্রথমবারের মতো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সুবিধা কমানোর প্রস্তাব রয়েছে এতে। বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা আত্মীয় যিনিই হোন না কেন, সবাইকে জামানত দিয়ে ঋণ নিতে হবে। আর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশ যাওয়া আটকে দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশ্য সরকারি নানা সুবিধা পেয়ে যাঁরা খেলাপির তালিকার বাইরে থাকেন, তাঁদের কোনো সমস্যা হবে কিনা; স্পষ্ট নয়। 

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সামর্থ্য থাকার পরও ঋণ পরিশোধ না করলে; জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে ঋণ নিলে; যে উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়েছিলেন, সেই উদ্দেশ্যে তা ব্যয় না করলে তাঁকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বলা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার পর কেউ তা না দিলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক একটি তালিকা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ব্যাংক যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা না পাঠায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন ওই ব্যাংককে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে।

ঋণ পরিশোধে খেলাপি গ্রাহকরা প্রথমে নোটিশ পাবেন। নোটিশ পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে তাঁকে টাকা পরিশোধ করতে হবে। না করলে অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে টাকা আদায়ের যে প্রচলিত ব্যবস্থা রয়েছে, তা চলমান থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা, তাঁদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও কোম্পানি নিবন্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যবস্থা করতে পারবে।

৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার আগে আইএমএফ টিম বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে এক পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বলে আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি।  

বস্তুত ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা আংশিক ইতিবাচক। ব্যাংক খাতে সংস্কার দরকার, আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আগে আইএমএফও এই পরামর্শ দিয়ে গেছে। তবে আধা- খ্যাঁচড়া কাজ করে এ খাতের কোনো লাভ হবে না বলেই আমাদের মতো তারাও মনে করে।


ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যাংক মনে করে যে তার বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাহলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। আর্থিক অবস্থা খারাপ বলতে তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি খারাপ হওয়া এবং সুশাসন বজায় রেখে পরিচালনা সম্ভব না হওয়াকে বোঝানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করবে। তার আগে একটি পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা দাখিল করবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক দুই বছর সময় দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কিনা, তা দেখবে। পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে অবসায়নই হবে ব্যাংকটির অনিবার্য পরিণতি।

সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর দেউলিয়া ঘোষণা করার বিধানও রাখা হচ্ছে আইনে। তবে বাঁচানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ, অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি সুযোগ রাখবে। দুর্বল ব্যাংক সবলের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে ঠিক, তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে দুর্বল কোনো ব্যাংক ভালো কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেন ওই ভালো ব্যাংকটিকেও নাজুক না বানিয়ে ফেলে।

আইনের খসড়া অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াতও পাবেন না তাঁরা। কোনো পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো পদেও তাঁরা থাকতে পারবেন না। বিদেশ ভ্রমণ ঠেকানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপিদের গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন; ট্রেড লাইসেন্স এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিঠি পাঠাবে।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুটি কমিটি থাকবে। একটি কমিটি তাঁদের চিহ্নিত করবে, আরেকটি কমিটি তা চূড়ান্ত করবে। পরে প্রতিটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করতে পারবেন। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না।

ব্যাংক নির্বাহীদের কেউ বলেছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এটা ভালো দিক। তাঁদের বিষয়ে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট করতে পারলে ইচ্ছা করে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। তাঁদের সঙ্গে আমিও কিছুটা একমত। তবে দুর্বল বিচারিক ব্যবস্থায় এর থেকে সুফল আনতে গেলে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। 

সাফল্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গেলে আবার রাতে যাতে পাঁচ তারকা হোটেলে একটি ভালোভাবে পরিচালিত ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন না হয়, কিংবা প্রধান নির্বাহীকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে তার জায়গায় নিয়মিত সময়ের বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নির্বাহী নিয়োগ না দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এমনকি দুর্বল বা ব্যর্থ ব্যক্তি-খাতের ব্যাংককে কুইনাইন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে যাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা নষ্ট না হয়, সেদিকেও উচ্চকিত নজর এবং দায়বদ্ধতা থাকতে হবে।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন

×