ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেন বাতিল করা প্রয়োজন

ফাইল ছবি।
সি আর আবরার, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও রেজাউর রহমান লেনিন
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৩ | ০৮:৫৬
২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার হরণসহ ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো নজিরও তৈরি করেছে। সংবিধানে নাগরিকের যেসব অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে; সেসবের বিপরীতে কূটকৌশলে এমন সব বিধিবিধান সংযোজন করা হয়েছে, যা সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রক্ষণীয় নয়। এই আইন কেবল যে নাগরিকের কণ্ঠ রোধ করছে, তা-ই নয়; এটি অপরাপর অধিকারও হরণ করছে, যা নাগরিকদের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। নাগরিকদের পক্ষ থেকে এই আইন বাতিলের দাবি ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে কেন এই আইন বাতিল করা প্রয়োজন, তা খোলাসা করা দরকার।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম একটি নতুন ধারণা এবং একে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমাদের এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, নাগরিকের ডিজিটাল সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রণীত আইনে সেই সুরক্ষার লেশমাত্র নেই। আইনটির প্রায় সব ধারা ও উপধারা নাগরিকদের মতপ্রকাশের সুরক্ষা ও স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও অন্যান্য নাগরিক অধিকারকে সীমিত; ক্ষেত্রবিশেষে খর্ব এবং নাগরিকদের জনবান্ধব কর্মকাণ্ডকে অপরাধীকরণ করেছে। আইন প্রণয়নের সময় নাগরিক সমাজের যথাযথ অংশগ্রহণ এবং মতামত প্রদানের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকার কারণে আইনটি সুরক্ষা প্রদানের পরিবর্তে কেবল নিয়ন্ত্রণমুখী নিপীড়নমূলক চেহারা ধারণ করেছে। এই আইনের মাধ্যমে মামলা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যেমন দমন করা হচ্ছে, তেমনি যে কোনো প্রকারের বিরুদ্ধ মতকে দমন করতে তা ব্যবহৃত হচ্ছে। এ যাবৎ যাঁদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে মোটাদাগে রয়েছেন ৩০১ জন রাজনৈতিক কর্মী, ২৮০ জন সাংবাদিক, ১৫৭ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ৬৪ জন শিশু।
এই আইনের মাধ্যমে যেসব কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে তার মধ্যে নিম্নোক্ত তিনটি বিশেষ দিক রয়েছে।
প্রথমত, এই ধারাগুলো জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রায় সব ধারার সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা ও অপ্রতুলতা রয়েছে; দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত চুক্তিতে অনেক অপরাধের সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে, যার সব ক’টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উল্লেখ করা হয়নি এবং আইনে অনেক অপরাধের সংকীর্ণ সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এবং অপরাধের অভিপ্রায় সম্পর্কে পর্যাপ্ত নজর রাখা হয়নি;
তৃতীয়ত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধগুলোর অনেকটিই ইতোমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনসহ অন্যান্য প্রচলিত আইনের বিভিন্ন ধারায় অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা আছে। এই আইনের এতটি অপরাধকে ভিন্ন-ভিন্ন ধারায় ব্যাখ্যা করার ফলে ধারাগুলো অত্যধিক বিস্তৃত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত চুক্তির বিকশিত মানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়নি। যার ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদেরও বিনা দোষে অপরাধী বানিয়ে দিতে পারছে এবং এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই প্রকারান্তরে আইনের অপব্যবহার হচ্ছে।
এ ছাড়া, আইন ও নীতিমালার অধীনে গঠিত ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির কার্যক্রমের প্রতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় বা সংস্থাগুলো কর্তৃক তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকা; একই বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে একাধিক মামলা করার প্রবণতা; বিচার-পূর্ব কারাবাসের সময় সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতির অনুপস্থিতি; বিচার-পূর্ব কারাবাসকে পরবর্তী সময়ে শাস্তি হিসেবে গণ্য করা; অপরাধের বিপরীতে ধারাগুলোর শাস্তির বিধান অধিকাংশে মাত্রাতিরিক্ত, অসম, অনুপাতহীন এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ থাকা; সাইবার ট্রাইব্যুনালের আদেশ বা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ না থাকা এবং মিথ্যা হয়রানিমূলক কোনো মামলার প্রতিকার আইনে না থাকায় তা আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা ও আইনের শাসনকে আরও জটিল এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। একই সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা, তা যে অভিযোগেই করা হোক না কেন; বিজ্ঞ বিচারকরা জামিন দেন না। মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তি এখতিয়ারাধীন নির্দিষ্ট সাইবার ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন না বরং এখতিয়ারভুক্ত দায়রা আদালতে যেতে হয়; সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন আবেদন নামঞ্জুর একটি গুরুতর ‘স্বাভাবিক’ প্রথায় পরিণত হয়েছে, যা সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি।
অন্যদিকে, তদন্ত কর্মকর্তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ৪০ অনুযায়ী তদন্ত শেষ করতে ৬০ দিন সময় পান এবং উচ্চতর কর্তৃপক্ষ তদন্ত সম্পন্ন করতে আরও ১৫ দিন সময় মঞ্জুর করতে পারেন। এই ৭৫ দিন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তদন্তের সময় বাড়ানোর ক্ষমতা সাইবার ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাবৃন্দ উপরোক্ত ধারার গুরুতর লঙ্ঘন করছেন। যেহেতু আইনে অভিযোগ প্রমাণ হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া জামিন পাওয়া যায় না, তাই আইনের কোনো নির্দিষ্ট বিধান যদি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ এবং বিচারকবৃন্দ প্রতিপালন না করে থাকেন, সে ক্ষেত্রেও আইনের কঠোর প্রয়োগ ও শাস্তির বিধান থাকা যুক্তিযুক্ত ছিল। এই আইনি অসমতা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা কোনো কোনো মামলায় দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রথমে সাময়িক সময়ের জন্য ‘জোরপূর্বক গুম’ এবং পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আটক বা ‘গ্রেপ্তার’ দেখানো হচ্ছে। আবার কোনো ব্যক্তির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরে এবং হেফাজতে মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার শিকারও হচ্ছেন, যা সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এবং উচ্চ আদালত কর্তৃক ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় প্রদত্ত নির্দেশনাগুলোর সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
আরও ভয়াবহ বিষয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হচ্ছে এবং ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কমপক্ষে ৫০ শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে ১৫টি জেলায় ৩৪টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমান সরকার এরই মধ্যে নতুন করে শিশু আইন প্রণয়ন করেছে এবং সেই আইনের বিধান মতে কোনো অভিযুক্ত শিশুকে শাস্তি প্রদান করার কোনো আইনগত সুযোগ নেই। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে ব্যাপকভাবে শিশুদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার ভঙ্গ করে গ্রেপ্তারপূর্বক বিচার করা হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ স্পষ্টত জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এটি বলা অত্যুক্তি হবে না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যত আইনের শাসন নয়; আইন দ্বারা শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনোভাবেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের রক্ষা করে না; বরং নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি করছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণের বাস্তবতা বিদ্যমান। তাই অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ বাতিল হওয়া প্রয়োজন।
সি আর আবরার, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও রেজাউর রহমান লেনিন: লেখকবৃন্দ যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী