সংস্কৃতি
নববর্ষ নিয়ে আপত্তি আফগানিস্তান থেকে অনুপ্রাণিত?

আনিসুর রহমান
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠা মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে ‘লিগ্যাল নোটিশ’ পাঠিয়েছিলেন ঢাকার একজন আইনজীবী। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন বরাবর পাঠানো ওই নোটিশে মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হলে উচ্চ আদালতে অভিযোগ করার ‘হুমকি’ ছিল।
বাংলাদেশে লিগ্যাল নোটিশকে অনেকে আইনি দিক থেকে ততটা গুরুত্ব দিতে চান না। ঢাকার ওই আইনজীবীর নোটিশও বিতর্কের ভিড়ে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা রেখে গেছে এক গুরুতর প্রশ্ন। এই নোটিশ কি নিছক ব্যক্তিবিশেষের ‘ধর্মীয় অনুভূতি’? নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে আফগানিস্তানের তালেবানি শাসনের ছায়া?
আফগানিস্তানের তালেবান ক্ষমতায় আসার পর শুরুটা হয়েছিল নববর্ষ উদযাপনের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তির মধ্য দিয়ে। শেষ পর্যন্ত তারা নববর্ষ উদযাপনই নিষিদ্ধ করেছিল। তারা নববর্ষ উদযাপনে ছবি তোলা এবং ছবি ও প্রতিকৃতি প্রদর্শন করারও বিপক্ষে ছিল। কেননা, তারা এগুলোকে ‘মূর্তিপূজা’ বলে মনে করত। আরও আছে– নারীদের দমনপীড়নের পাশাপাশি ইন্টারনেট, চিত্রকর্ম বা ফটোগ্রাফির মতো শিল্পের বেশিরভাগ সংস্করণ নিষিদ্ধ। ফুটবল, দাবাসহ খেলাধুলারও বিপক্ষে ছিল তারা। তারা বিনোদনমূলক কার্যকলাপ যেমন ঘুড়ি ওড়ানো এবং পায়রা ও অন্যান্য পোষা প্রাণী পালনেরও বিপক্ষে ছিল। তালেবান আমলের আফগানিস্তানে নিষ্ঠুরভাবে পোষা পাখিগুলোকে হত্যা করা হয়। প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আলোচ্য আইনজীবী তাঁর নোটিশের অনুকূলে আইনি প্রেক্ষাপট হিসেবে সংবিধানের ২১ (১) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এই অনুচ্ছেদে কী বলা আছে: সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। এই আইনি ধারার অনুকূলে তিনি মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের ‘দৈত্য আকৃতি’র পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন। এ জন্য দোহাই হিসেবে হাজির করেছিলেন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক-এর পাশাপাশি দণ্ডবিধির ২৯৫-ক ধারা।
অনুচ্ছেদ ২ক অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবেন। ওদিকে দণ্ডবিধির ২৯৫-ক ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ধর্মীয় স্থান বা সেখানকার কোনো বস্তু ধ্বংস করা, ক্ষতি করা বা অসম্মান করাকে ধর্মীয় অবমাননা হিসেবে গণ্য করা হবে। এ ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এখন প্রশ্ন– পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে কিংবা উল্লিখিত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আগে বা পেছনে কোথাও ন্যূনতম ধর্মীয় সংযোগ খোঁজার কোনো কারণ থাকতে পারে কি?
আইনজীবীর নোটিশটিকে অনেকে উর্বর মস্তিষ্কের উদ্ভট কাণ্ড বলে ধরে নিতে পারেন। যেমন তিনি মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত মাছ, পাখি আর প্রাণীর বিভিন্ন প্রতিকৃতির সঙ্গে দৈত্যের আকৃতির মিল খুঁজে পেয়েছেন! মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিকৃতিগুলো যে দৈত্যাকৃতির– এটা কীভাবে প্রমাণ হবে? দৈত্যের কোনো ছবি কি তাঁর কাছে আছে? বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জির ধারাবাহিকতায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অংশ হিসেবে বাঙালি নাচবে-গাইবে-আঁকবে এবং আনন্দে মাতোয়ারা হবে। এতে কে মুসলমান, কে হিন্দু; কে বৌদ্ধ, কে খ্রিষ্টান, কে আদিবাসী; কে বিশ্বাসী, কে অবিশ্বাসী– এ প্রশ্ন তোলারই সুযোগ কোথায়?
এই নোটিশ কোনো তাৎক্ষণিক ভ্রান্তি বা ক্ষোভের বহিপ্রকাশ নয়; বরং সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের বহুল সমালোচিত ১৩ দফার ৭ নম্বর দাবি ছিল- ‘মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।’ ঢাকার ‘বিজ্ঞ’ আইনজীবীর এই নোটিশ কি তারই ধারবাহিকতা?
অথচ বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক উৎসবগুলোর অন্যতম প্রধান পার্বণ। এ ধরনের উদযাপন যেমন অর্ধসহস্র বছর আগে সুবা বাংলা আমলে বলবৎ ছিল; তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও আছে। আজকে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের যে ধারা; অনাগতকালে এই ধারার সঙ্গে আরও অনেক কিছু যোগ হতে পারে বৈকি।
ধারণা করা যায়, অদৃশ্যে আর দৃশ্যে আইনজীবীর আরও দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে, তিনি খবরের শিরোনাম হয়েছেন। এটি তাঁর আইন পেশায় পসার বাড়াতে কাজে দেবে। দ্বিতীয়ত, তাঁর পেছনে বিশেষ কোনো মহল থাকতে পারে, যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চায় না। তারা চায়, এখানে আফগানিস্তানের ছায়া গাঢ় হতে থাকুক। নব্বই দশকে এই দেশেই ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ দেয়াললিখন দেখা গিয়েছিল– ভুলে যাওয়া চলবে না। সেই সব শক্তি যে নানা মাত্রায় এখনও সক্রিয়– সেটা হফল করেই বলা যায়।
শেষ কথা অবশ্য এভাবে বলা যায়, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি যুগে যুগে, শতাব্দীকাল এভাবে লড়াই করে টিকে থেকেছে। সর্বশেষ পাকিস্তান আমলেও রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাংলা অক্ষরের বদলে আরবি হরফে বাংলা ভাষা লেখার পাঁয়তারা চলছিল। কোনো কিছুই হালে পানি পায়নি। সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবিক বোধসম্পন্ন নাগরিকরা ঐক্যবদ্ধ এবং বাঙালির আত্মপরিচয়ের বিকাশ অব্যাহত থাকলে এখনও হালে পানি পাবে না।
আনিসুর রহমান: বাঙালি-সুইডিশ কবি ও নাট্যকার; সুইডিশ লেখক সংঘের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য
- বিষয় :
- সংস্কৃতি
- আনিসুর রহমান