ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সমকালীন প্রসঙ্গ

পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ-জ্বালানির খোঁজে

পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ-জ্বালানির খোঁজে

মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৩ | ২২:২৪

সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) শিক্ষার্থী ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি প্রকৌশল সংঘের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ বিষয়ে মূল বক্তব্য প্রদান করি। সেমিনারে এমআইটি, হার্ভার্ড, বোস্টন, নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ এখানকার প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও বিশিষ্টজন মিলে শতাধিক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল বেশ লক্ষণীয়। সেমিনারের সিদ্ধান্ত– উদ্ভাবনী, জ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে জ্বালানি নিরাপত্তা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ অত্যাবশ্যক।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ অনেকেরই ধারণা– সাধারণ নাগরিক, পেশাজীবী কিংবা সুশীল সমাজকে ধারণা দিতে গেলে তাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারেন। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশে বসবাসকারীরা এ প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকার কারণে এর পক্ষে কাজ করে থাকেন। এমনকি রেডিয়েশনের ভয় দেখিয়ে গুজব রটালেও এর বিরুদ্ধে তাঁদের দাঁড় করানো যায় না। তাঁরা অন্ধকারে থাকলেই বরং সমস্যা। আরও বলে রাখা দরকার, ইউরেনিয়াম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সবুজ জ্বালানি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক এবং এ খাতে ঋণ দেওয়ার জন্যও তারা প্রস্তুত। তাহলে বোঝা গেল, সৌর ও বায়ুর পাশাপাশি পারমাণবিক শক্তিও পরিবেশসম্মত জ্বালানির ভিত্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের সরকার কি এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে?

জলবায়ুর বিপর্যয় ঠেকাতে বিশ্বব্যাংক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আর কোনো ঋণ দেবে না। গ্যাসের অস্থির বিশ্ববাজার কতটা ভোগান্তিতে ফেলতে পারে, তা ইতোমধ্যে সরকার টের পাচ্ছে। সম্ভবত সে কারণে বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা দু’দফা সংশোধনের পর এখন নতুন করে তা প্রণয়নে কাজ চলছে যেখানে সবুজ জ্বালানিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টা যেন সত্য হয়, তার জন্যই এ আলোচনার সূত্রপাত।

আমরা জানি, সৌর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ও গবেষণার কারণে ইতোমধ্যে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। ফলে সৌর কোষের দক্ষতা যেমন বেড়েছে, তেমনি ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় অনেক কমেছে, যা কিনা কয়লা ও তেলের তুলনায় কম। তদ্রূপ বায়ুশক্তির বেলায়ও ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক কম। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে চাহিদামতো বিদ্যুৎ পাওয়া এবং সংরক্ষণ করার জন্য টেকসই প্রযুক্তি অর্থাৎ ব্যাটারি।

তবে পারমাণবিক শক্তি ‘ফিশান’ ও ‘ফিউশান’ আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট লোকজন মনে করছেন। আমি যেহেতু এমআইটিতে চতুর্থ প্রজন্মের ফিশানভিত্তিক পারমাণবিক প্রযুক্তি যেমন ছোট ও মাইক্রো মডিউলার চুল্লির উন্নয়নে কাজ করছি, তাই বলতে পারি, এ ধরনের চুল্লিতে চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমার মতো পরিণতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। চুল্লি স্থাপনে প্রাথমিক বিনিয়োগও বর্তমান প্রজন্মের ৩+ (রূপপুর)-এর এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ হবে। নির্মাণে সময় লাগবে ১-৫ বছর; বর্জ্য উৎপাদনের হার অনেক কম হবে এবং ব্যবহৃত জ্বালানি দণ্ড, যা উচ্চ তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নামে পরিচিত সেগুলো কম তেজস্ক্রিয় বর্জ্যে রূপান্তর করার প্রযুক্তি আসছে। ফি বছর জ্বালানি ভরতে হবে না। ৫ কিংবা ১০ বছর পরপর জ্বালানি দেওয়ার সুবিধাও থাকছে এবং চাহিদামাফিক সব স্থানে এমনকি জরুরি অবস্থায় দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগের লক্ষ্যে এদের বসানো যাবে।

চতুর্থ প্রজন্মের ফিশানভিত্তিক পারমাণবিক প্রযুক্তির এ চুল্লি থেকে নির্মল বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সাশ্রয়ীভাবে সবুজ হাইড্রোজেন জ্বালানিও তৈরি করা যাবে। সৌর ও বায়ু প্রযুক্তির মাধ্যমেও হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরির সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে। এখন গবেষণা হচ্ছে হাইড্রোজেন জ্বালানির সাশ্রয়ী সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থার ওপর। জ্বালানি সংরক্ষণে উন্নত ও সাশ্রয়ী ব্যাটারি উদ্ভাবনে গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

আরেকটি সুসংবাদ হচ্ছে, প্রথমবারের মতো গত বছর ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বিজ্ঞানীরা একটি ফিউশন বিক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন, যা ব্যয়ের চেয়ে বেশি শক্তি উৎপাদন করেছে। এটি একটি বড় ধরনের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, যা ফিউশনভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পথ প্রশস্ত করবে এবং নির্মল বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ হবে। এই প্রযুক্তিতে দুর্ঘটনা বা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরির কোনো সমস্যা নেই। যার ফলে ফিউশানভিত্তিক পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে বিশ্বে ৩৩টি কোম্পানি তৈরি হয়েছে এবং কয়েকটি কোম্পানি নির্মাণকাজে হাতও দিয়েছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে। এখন কাজ হচ্ছে, প্রযুক্তি টেকসই ও সহজলভ্যকরণ। ফিউশানভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মূল জ্বালানি হচ্ছে হাইড্রোজেন। সমুদ্রের পানি হচ্ছে এই হাইড্রোজেনের মূল উৎস, যা সরবরাহের কখনও ঘাটতি হবে না এবং জলবায়ু উষ্ণায়নে কোনো ভূমিকা রাখবে না। সে জন্য অনেকেই বলছেন, আগামীতে কয়লা, তেল, গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব উপায় আধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। আমরা এখন নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারছি, রেডিয়েশনের ঝুঁকির চেয়ে জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনেক বেশি ভয়াবহ হবে।

একুশ শতকের মাঝামাঝিতে আমরা আশা করতে পারি, জীবাশ্ম জ্বালানিবিহীন সব ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব নির্মল বিদ্যুৎ উৎপাদন। তখন তেল কিংবা গ্যাস নিয়ে তেল উৎপাদনকারী দেশের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের বৈরী মনোভাব তৈরি হবে না। জ্বালানিনীতিতে আলোচিত আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর প্রক্ষেপণ করে সে অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে সময়োচিত পদক্ষেপ। এ প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে প্রয়োজন প্রায়োগিক গবেষণা, পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও শিক্ষিত জনবল তৈরি।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম: ভিজিটিং প্রফেসর ও ফুলব্রাইট স্কলার, নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), যুক্তরাষ্ট্র ও প্রফেসর, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×