নারী
টেকসই উন্নয়নের পথে বাল্যবিয়ের চ্যালেঞ্জ

তাসলিমা তামান্না
প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৩ মে ২০২৩ | ০৪:২৬
বছর দশেক আগের কথা। বাসার সাহায্যকারীর মেয়ে আমেনার সঙ্গে দেখা। সঙ্গে ছোট ছোট দুই ছেলে। আমেনা জানাল, কয়েক দিন আগেই তার স্বামী মারা গেছে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার এক বছরের মাথায় আমেনা এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। এর এক বছর পর আরও একটি ছেলের জন্ম হয়। বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিধবা হিসেবে ছোট দুই সন্তান নিয়ে আমেনা আশ্রয় নেয় বাবার বাড়িতে।
কয়েক দিন আগে আমেনার সঙ্গে আবার দেখা। তার বয়স এখন ২৯ বছর। এর মধ্যে তার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। নিজে অসুস্থ হওয়ায় এতটা বছর সন্তানদেরও সে ঠিকমতো যত্ন নিতে পারেনি। জরায়ুতে সমস্যা দেখা দেওয়ায় সেটা অপারেশন করে ফেলে দিতে হয়েছে। অপুষ্টির কারণে চোখের দৃষ্টিও হয়েছে ঝাপসা। আমেনার মা ওই সময় জানিয়েছিলেন, গ্রামে উঠতি বয়সী মেয়ে ঘরে রাখা নিরাপদ ছিল না। মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন।
সময় গড়িয়ে গেলেও এ চিত্র যে খুব একটা পাল্টায়নি, তা বোঝা যায় বাল্যবিয়ে নিয়ে সম্প্রতি ইউনিসেফের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের শৈশবে। দেশে বাল্যবিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও বিশ্বের মধ্যে অষ্টম। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৪৫ লাখ নারীর বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই। ১ কোটি ৩ লাখ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগে। অথচ বাল্যবিয়ের জন্য দেশে আইন আছে। আছে শাস্তির বিধান।
বাল্যবিয়ের কারণ নিয়েও ইউনিসেফ জরিপ চালিয়েছে। সেই জরিপ থেকে জানা যায়, সামাজিক ও ধর্মীয় চাপ, দারিদ্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাজনিত কারণে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। বাল্যবিয়ের জন্য যৌতুকও আরেকটি কারণ। মেয়ের বয়স যত বেড়ে যাবে, তার জন্য তত বেশি যৌতুক দিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও বাংলাদেশের অনেক এলাকায় বাল্যবিয়ে হচ্ছে। বন্যা, খরা কিংবা নদীভাঙনের কারণে অনেক পরিবারেই নিরাপত্তার সমস্যা কাজ করে। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় দারিদ্র্য। তখন মেয়েদের স্কুলে পড়ানো বাদ দিয়ে অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে দেন। আবার করোনাকালে ও পরবর্তী সময়ে এ হার বেড়েছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে বাল্যবিয়ে বেড়েছে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বাল্যবিয়ে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ পূরণের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। টেকসই উন্নয়নে ৫ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে নারী-পুরুষের সমতার কথা। কিন্তু বাল্যবিয়ে বন্ধ না হলে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বাল্যবিয়ে বন্ধ না হলে লক্ষ্যমাত্রা ১. দারিদ্র্য বিমোচন, লক্ষ্যমাত্রা ৩. সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ, এমনকি লক্ষ্যমাত্রা ৪. মানসম্মত শিক্ষা অর্থাৎ সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি সম্ভব হবে না।
বাল্যবিয়ের নানা কুফল পড়ে একজন মেয়ের শরীর ও মনে। প্রথমত, অল্প বয়সে শারীরিক সম্পর্ক অনেক মেয়ে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। তারপর সে যদি অন্তঃসত্ত্বা হয়, তাহলে নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তার নিজের শারীরিক গঠনই যখন পরিপূর্ণ হয় না, তখন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সে রক্তশূন্যতায় ভোগে। সন্তানের যত্নও ঠিকমতো নিতে পারে না। এতে শিশুর বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না, যা তার পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে। অনেক সময় অপূর্ণাঙ্গ শিশুরও জন্ম দেয় অল্প বয়সী মা। অনেক সময় আবার অল্প বয়সে মা হলে মেয়েদের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। এতে জরায়ুতে ইনফেকশন ও ক্ষত হয়। ঘন ঘন সন্তান হলে মায়ের স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ে। নারীর শারীরিক অসুস্থতা অনেক সময় দাম্পত্য সংকটও ডেকে আনে।
বাল্যবিয়ে দূর করা না গেলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জন যে বাংলাদেশের জন্য সম্ভব নয়, সেটা বলা বাহুল্য। কারণ ১৮ বছরের আগে যখন একটি মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, তখন সে লেখাপড়া শেষ করতে পারছে না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। তার জন্য স্বাবলম্বী হওয়ার দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের অংশীদার হয়ে সে দেশের কাজে লাগতে পারছে না। এখানেই প্রথম একটা অসমতা তৈরি হচ্ছে সামাজিকভাবে, যা জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রা ৫-এ উল্লেখ করা আছে।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারের নানা কর্মসূচি রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনও এখন অনেক তৎপর। প্রায়ই শোনা যায়, কোথাও বাল্যবিয়ের সংবাদ পেলেই প্রশাসন গিয়ে তা প্রতিহত করছে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দিচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া বিয়ে দেওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। তারপরও নানা কৌশলে বিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে মেয়ের বয়স বাড়িয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়। কখনও আবার দুই পরিবারই গোপনে বিয়ে সারে।
শুধু সচেতনতা বাড়ানো কিংবা আইন প্রণয়ন করে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা বা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। এ জন্য এর পেছনের কারণগুলোর ব্যাপারেও সজাগ হতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে দারিদ্র্য কমানো, মানুষের সক্ষমতা বাড়ানো, সর্বোপরি মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ খুবই জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
তাসলিমা তামান্না: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
- বিষয় :
- নারী
- তাসলিমা তামান্না
- টেকসই উন্নয়ন
- বাল্যবিয়ে
- বিয়ে