ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সমকালীন প্রসঙ্গ

নরসিংদীর ঘটনা দেশের জন্য শুভ লক্ষণ নয়

নরসিংদীর ঘটনা দেশের জন্য শুভ লক্ষণ নয়

খুশী কবির

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১২ মে ২০২৩ | ১৯:৪৭

নরসিংদীর বেলাব উপজেলার পাটুলীতে লালন সংগীতের আখড়াবাড়ি পুলকিত আশ্রমের সাধুসঙ্গে হামলা এবং বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুরের ঘটনায় আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। হামলায় তিনজন বাউল শিল্পী আহত হয়েছেন। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। চাইলেই এসব বাদ্যযন্ত্র সংস্কার করা যাবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার সময়ও দেখা গেছে, হামলাকারীরা খুঁজে খুঁজে হারমোনিয়াম ভাঙচুর করেছে। যেন তাদের সব আক্রোশ হারমোনিয়ামের ওপর। একতারা, দোতারা, হারমোনিয়াম আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এগুলোর ওপর সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ও ধর্মান্ধদের ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়। পরিবার থেকে এমন শিক্ষা নিয়েই বেড়ে উঠেছে তারা।

আগে গ্রামেও বিভিন্ন পরিবারে গানের আসর বসত। কোনো কোনো বাড়িতে পেশাদার প্রশিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সন্তানদের গান শেখানো হতো। প্রায় বাড়ির দরজায় মক্তব ছিল। এখানে ভোরবেলা শিশু-কিশোররা ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করত। নামাজ শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান শিশু-কিশোররা এসব মক্তব থেকেই পেত। ভোরবেলা মক্তবে কোরআন-হাদিস শিখে বিকেলে গান শিখত আমাদের শিশুরা। এখন আগের মতো মক্তব নেই। যা আছে তাতে আবার শিশুদের মধ্যে ভিন্ন চিন্তা জাগ্রত করার অপপ্রয়াস চলে। শহরের বাড়িতেই এখন আর গান শেখানোর আসর বসে না; গ্রামের কথা তো বাদ। শৈশব থেকে শিশুদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ জাগ্রত না করে সাম্প্রদায়িক চিন্তা ঢুকিয়ে দিলে এর পরিণাম ভয়াবহ হবেই।

সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, সোমবার পুলকিত আশ্রমে সাধুসঙ্গের দিন ধার্য ছিল। সে উপলক্ষে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাধু-ফকির, বাউল শিল্পীরা আগে থেকেই আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন। রোববার দুপুরে শেখ জাহাঙ্গীর ও শাহীনের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়জন সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রসহ জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়াকে খুঁজতে আশ্রমে আসে। জাহাঙ্গীরকে না পেয়ে তারা আশ্রমে হামলা শুরু করলে তাদের বাধা দেন বাউল শিল্পীরা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শিল্পীদের ওপর হামলা চালায় তারা। এ সময় কুষ্টিয়া থেকে আসা লালন সংগীতশিল্পী রিয়াদ ভূঁইয়া, মিন্টু ফকির ও রাকিব ফকির আহত হয়েছেন। এমনকি তাঁদের সঙ্গে থাকা তানপুরা, দোতারাসহ সব বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দেওয়া হয়েছে। লালন সংগীতচর্চা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করছেন শিল্পীরা। লালন চর্চার সঙ্গে ইসলামের উদারপন্থি ধারা সুফিবাদের একটা সম্পর্ক আছে। আর ইসলামের চরমপন্থি ধারা ওয়াহাবিবাদের অনুসারীরা কখনোই সুফিবাদের ধারণাকে সমর্থন করে না। ফলে তারা বিভিন্ন সময় সুফিবাদীদের ওপর হামলা চালায়। আমাদের এখানে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে সুফিবাদীদের হাত ধরে। চরমপন্থিদের মাধ্যমে ইসলাম এতটা গভীরে পৌছতে পারত না। যদি বলা হয়, এ ধরনের হামলার মধ্য দিয়ে ইসলামের মাহাত্ম্যকে ছোট করা হচ্ছে; তাহলেও ভুল হবে না।

নরসিংদীর এ হামলার মধ্য দিয়ে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমি সম্প্রতি টাঙ্গাইলের গ্রামাঞ্চল ঘুরে ঢাকা ফিরেছি। সে এলাকার মানুষের কাছে মূল শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা। মূলধারার শিক্ষা তাদের কাছে গৌণ। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এমনকি শিশুরাও আপাদমস্তক বোরকায় ঢেকে রাস্তায় চলাচল করছে। এসব দেখে মনে হয়েছে, জামায়াতসহ সমাজের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নতুনরূপে শক্তি সঞ্চার করছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সেখানকার একটি বাজারে একজন পরিচিত বক্তা মাহফিল করতে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বলে এসেছেন, যে বাজারে নাটক, গান, যাত্রা হয়, সেই অপবিত্র মাটিতে তিনি মাহফিল করতে পারেন না। তাই ওয়াজের স্বার্থে বাজারটিকে পবিত্র রাখার তাগিদ দিয়ে এসেছেন সেই বক্তা। যারা গান, নাটক, যাত্রা করে, তাদের কল্লা কেটে ফেলার উস্কানি দিয়ে এসেছেন তিনি। শুনেছি, এ বক্তা একবার কিশোরগঞ্জে মাহফিলে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এতে গ্রেপ্তার হন তিনি। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটাক্ষ করলে গ্রেপ্তার করা যায়। করা উচিতও। সংস্কৃতির বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ালেও গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদানকারীদের সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই।

রাজনৈতিক দল ও সরকার তাদের স্বার্থে আপস করার কারণে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতারা পার পেয়ে যাচ্ছে। ধর্মের অপব্যবহার হচ্ছে। সংস্কৃতিবিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জঙ্গি তৈরি করছে। তারা প্রকাশ্যে কল্লা কাটার কথা বলার মাধ্যমে জঙ্গিবাদকে উস্কে দিচ্ছে। তারা কীভাবে অবাধে মাহফিলের অনুমতি পায়? অথচ আমরা অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রশাসন থেকে অনুমতি পাই না। সম্প্রতি তেঁতুলতলা মাঠ দখলমুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমরা একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। এটি করতে পুলিশ অনুমতি দিতে চায়নি। পরে উচ্চ পর্যায় থেকে তারা বার্তা পেয়ে আমাদের অনুমতি দেয়। কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলের চারপাশে পুলিশ এমনভাবে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়িয়েছিল; দেখে মনে হচ্ছিল কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন অনুষ্ঠান করছে।

বেলাবর মতো ঘটনা দেশের অন্য স্থানেও ঘটছে। এটি শুভ লক্ষণ নয়। সরকার এখনই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এরা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। তখন এদের লাগাম টেনে ধরা কঠিন হবে। আমরাও এসব হামলার দায় এড়িয়ে যেতে পারি না। আমরা চুপচাপ থেকে এদের প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি। বেলাবতে হামলার সময় স্থানীয়রা যদি প্রতিহত করত, তাহলে হয়তো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রাখা যেত। সরকারের পক্ষ থেকে হামলাকারী ও উস্কানিদাতাদের কঠোর বার্তা দিতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস না পায়।

বাউল গান, পল্লিগীতি সবাই পছন্দ করে। শহরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও শাহ আবদুল করিমের গান শুনতে আগ্রহী দর্শকের সংখ্যা থাকে শীর্ষে। শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করা শিল্পী ও তাঁদের বাদ্যযন্ত্র ভাঙার সঙ্গে জড়িতরা আসলে বাঙালি চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাউল দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি কট্টর হিন্দু ছিলেন না; ব্রাহ্ম ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। অনেক জ্ঞানী-গুণীকে আমরা চিনি, যাঁরা লালনভক্ত।

সরকারি অর্থায়নে দেশে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে ইসলামিক গবেষণা হলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এটি যেন মৌলবাদের আখড়া না হয়। যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে মৌলবাদীরা যে কোনো স্থান থেকেই উস্কানি দিতে পারে। আমরা ধর্মচর্চার স্বাধীনতায় যেমন বিশ্বাসী, তেমনি ধর্মান্ধতা ও ধর্মব্যবসায়ের বিরুদ্ধে। ধর্মান্ধরা উস্কানি দিয়ে ভিন্নমত দমনের পাশাপাশি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং ধর্মব্যবসায়ীরা এ থেকে ফায়দা লোটে। আর তখন বেলাব, নাসিরনগর, রামু, কুমিল্লার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যদি নিজেদের সংস্কৃতি সুরক্ষিত না হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কী হতে পারে!

খুশী কবির: সমন্বয়ক, নিজেরা করি

আরও পড়ুন

×