বশেমুরবিপ্রবি
শিক্ষকের মর্যাদা ও কোষাধ্যক্ষের সাংস্কৃতিক মান

জাকিয়া সুলতানা মুক্তা
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৩ | ১৮:০০
একজন বিতর্কিত উপাচার্যের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) নাম প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আসত, অবধারিতভাবেই তাঁর নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে। ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ওই উপাচার্য পদত্যাগের পর বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা স্বস্তিতেই ছিলাম। অতীতের তিক্ততা ভুলে সবাই যখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন, তখন কোষাধ্যক্ষ পদে অবসরপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপককে নিয়োগ দেওয়া হয়। বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষকদের প্রত্যাশা ছিল, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে থাকা এত বছরের বঞ্চনা এবার দূর হবে। কারণ ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পারিতোষিকের হার নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর তা আর পুনর্নির্ধারিত হয়নি। অথচ গত এক যুগে অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পারিতোষিকের হার কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি তাঁর কিছু কর্মকাণ্ডে বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষকসমাজ যেভাবে অপমানিত ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন, তা মর্যাদাশীল মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন।
ঘটনার সূত্রপাত গত ২৪ মে, শিক্ষকদের পদোন্নতি-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে গঠিত একটি কমিটির সভায়। চাকরিকাল গণনার জন্য ওই কমিটিতে সভাপতি হিসেবে স্বয়ং প্রশাসনপ্রধান উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, দুটো ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ বহিঃস্থ সদস্য (একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক ও একজন অভিজ্ঞ রেজিস্ট্রার), এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এবং শিক্ষক সমিতির দু’জন প্রতিনিধিসহ মোট ১২ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে শিক্ষকদের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন কোষাধ্যক্ষ।
কমিটির বিষয়টি খোলাসা করতে হলে একটু পেছনে ফিরতে হবে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য কোনো পদোন্নতি নীতিমালা ছিল না। ফলে সব অংশীজন দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছিলেন। ২০১৬ সালে শিক্ষকদের দাবির মুখে তৎকালীন উপাচার্য ‘নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা’ প্রণয়ন করেন, যা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ রিজেন্ট বোর্ড অনুমোদিত। এই নীতিমালার (ঙ) নং সাধারণ বিধানে পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি অস্পষ্ট বিধান যুক্ত করা হয়- ‘সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংগতিপূর্ণ পদে সরকারি, বেসরকারি, সরকারস্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে চাকরিকালের ৪০ শতাংশ সময়কাল অভিজ্ঞতা হিসেবে গণ্য করা হবে।’ আর অস্পষ্ট বিধানের ফাঁক গলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি পান। এই প্রেক্ষাপটেই ২০১৯ সালের উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও সোচ্চার হয়েছিলেন। পরে একজন রুটিন উপাচার্য এক বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করলেও ওই বিধান পরিবর্তন করা তাঁর এখতিয়ারভুক্ত ছিল না। চলতি উপাচার্যের মেয়াদ তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও নীতিমালার অস্পষ্ট বিধানটি বাতিলের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে পদোন্নতির ক্ষেত্রে আবেদনকারীরা শিক্ষকতা ও গবেষণার অভিজ্ঞতার বাইরে অন্যান্য চাকরির ৪০ শতাংশ অভিজ্ঞতাও দেখাতে পেরেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন মেয়াদের শেষ বছরে এসে রিজেন্ট বোর্ডে নীতিমালাটির পরিবর্তন না করেই আকস্মিকভাবে কিছু শিক্ষকের পদোন্নতির আবেদন আটকে দেয়।
বিষয়টি বর্তমান শিক্ষক সমিতির দৃষ্টিগোচর হলে এর সন্তোষজনক সমাধানের জন্য উপাচার্যের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনায় বসে। সমস্যা সমাধানে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির সভা চলাকালে কোষাধ্যক্ষ কোনো যুক্তিতর্কে যাননি। তাঁর একপক্ষীয় দাবি ছিল আলোচনা না করেই সব আবেদন বাদ দিতে হবে। কিন্তু কোন যুক্তিতে তা করতে হবে, এ ব্যাপারে তিনি বশেমুরবিপ্রবি পদোন্নতি নীতিমালার কোনো বিধান যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি। বয়স্ক মানুষ বিবেচনায় তাঁর কথায় কেউ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। শুধু উপাচার্য তাঁকে বেশ কয়েকবার এ রকম একপক্ষীয় মন্তব্য না করার জন্য অনুরোধ করেন। সভায় তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে হঠাৎ করে প্ল্যানিং দপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে ডেকে আনেন। এরপর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর প্রাপ্য গাড়ির ব্যবস্থা তখনও কেন হয়নি, এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে প্রাপ্য তাঁর গাড়ির ওপর ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা আছে জেনে অকস্মাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে বিষোদ্গার ও গালাগাল করতে থাকেন। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় উপস্থিত সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।
পরবর্তী সময়ে সাধারণ শিক্ষকরা তাঁর ওই অভব্য আচরণের প্রতিবাদে ২৯ মে মানববন্ধন এবং তাঁকে শিক্ষক-সংক্রান্ত যে কোনো সভা থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এতে তিনি আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং ‘কমিটির সভায় অবৈধ দাবিদাওয়া পাস হচ্ছে’ মর্মে শিক্ষকদের অভিযুক্ত করতে থাকেন। যদিও ওই সভায় সেদিন বা এখনও পর্যন্ত কোনো আবেদনকারীর চাকরিকাল গণনার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করে কয়েকটি প্রশ্ন রাখতে চাই। আমরা সবাই কোষাধ্যক্ষের জ্ঞান ও সামাজিক অবস্থানের তুলনায় ‘অযোগ্য’ হতেই পারি। এ কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অসম্মান ও গালাগাল করতে পারেন? যদি শিক্ষকরা অন্যায্য দাবি তুলেই থাকেন, তিনি কোনো একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলতে পেরেছেন? তবে কিসের ভিত্তিতে তিনি এতজন শিক্ষককে প্রকাশ্য অপমান ও অপদস্থ করছেন? একজন অধ্যাপক ও বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে তিনি কি আইনের ঊর্ধ্বে? এভাবে অপেশাদার আচরণ তাঁর অধিকারের মধ্যে পড়ে? এর মধ্য দিয়ে তাঁর সাংস্কৃতিক মান কি স্পষ্ট হয় না?
আমি নিতান্তই একজন সাধারণ শিক্ষক। জ্ঞানত কোনো অন্যায়ের সঙ্গে বা অন্যায় কোনো সুবিধা কখনও নিইনি। অর্থকড়ি আমার তেমন নেই– এ কথা সত্য। একই সঙ্গে এটিও সত্য যে আত্মসম্মানই আমার সম্বল। এতটুকু সম্বলের ক্ষতিপূরণ আমার মতো সাধারণ শিক্ষক কি পেতে পারে না?
জাকিয়া সুলতানা মুক্তা: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ
[email protected]
- বিষয় :
- বশেমুরবিপ্রবি
- জাকিয়া সুলতানা মুক্তা