অর্থনীতি
নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি বাগে আসবে?

মামুন রশীদ
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩ | ১৮:০০
আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই বলেছিল, মূল্যস্ফীতি বাগে আনাই এর প্রধান চ্যালেঞ্জ। অনেকে আবার আইএমএফের চাপ বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে মোকাবিলা করে, তার দিকেও নজর রাখছিলেন। অর্থনীতির সহজ পাঠ– সুদহার বাড়লে চাহিদা কমবে, এমন ধারণা থেকেই এ মুদ্রানীতি সাজানো হয়েছে। যে কারণে বিদ্যমান ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে আগামী মাস থেকে নতুন পদ্ধতি চালুর ঘোষণা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। এতে বাজারে সামগ্রিকভাবে সুদহার বাড়বে। অবশ্য নতুন ব্যবস্থায় বড় ঋণের তুলনায় ছোট ঋণে সুদ বাড়বে বেশি।
নতুন মুদ্রানীতি ও নতুন সুদহার আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। নুতন সুদহারকে বলা হচ্ছে ‘স্মার্ট’ বা শর্ট টার্ম মুভিং অ্যাভারেজ রেট। এটি নির্ধারিত হবে ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে যোগ করতে পারবে ৪ শতাংশ। বর্তমানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ শতাংশের নিচে। গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার হবে ১০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ যোগ করতে পারবে।
ওদিকে মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার হিসেবে বিবেচিত ‘রেপো’ সুদ ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখার জন্য ব্যবহৃত ‘রিভার্স রেপো’ সুদ ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও আগামীতে রিভার্স রেপো বলে আর কিছু থাকবে না। পাশাপাশি স্পেশাল রেপোর সুদহার বিদ্যমান ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এবারের মুদ্রানীতিতে আইএমএফের শর্তের প্রতিফলনও রয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বলতে শুনেছি, আইএমএফ তার সদস্য দেশকে বিভিন্ন পরামর্শ দিতেই পারে। আমরা কখনও মানি, কখনও মানি না। বর্তমানে বিদেশি ঋণের সুদহার ৮ থেকে ৯ শতাংশ। আইএমএফ ২ শতাংশের কম সুদে ঋণ দিচ্ছে। সস্তা ঋণ নিতে হলে তো কিছু কথা শুনতে হয়। তবে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে জুনে নিট রিজার্ভ প্রায় ২৪ বিলিয়নে উন্নীত করার যে শর্ত দিয়েছে, সেটি মানতে না পারলেও কোনো সমস্যা হবে না।
আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস সম্প্রতি দেশের ঋণমান কমিয়েছে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলছিলেন, ঋণমান কমানোর পেছনে ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেননা, ২০১২ সাল থেকে সংস্থাটি আমাদের রেটিং করে আসছে। তখন যা রিজার্ভ ছিল, আমদানি-রপ্তানি ছিল, অর্থনীতির যে অবস্থা ছিল, তার চেয়ে এখন অনেক ভালো। মাঝে রিজার্ভ অনেক বেড়েছিল। অথচ ঋণমানের কোনো পরিবর্তন করেনি। ফলে যেসব কারণে রেটিং কমানো হয়েছে, তাতে তাঁদের কিছু আসে যায় না।
যেহেতু দেশের সার্বভৌম ঋণমান নির্ধারণ কাজের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত ছিলাম এবং অনেক দেশে ‘কান্ট্রি রিস্ক’ নিরীক্ষা করার সুযোগ হয়েছে, তাই এতে বেশ আশ্চর্য হয়েছি। সরকারি কর্মকর্তারাও সব জায়গায় যেন নতুন করে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ এবং সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার যেন প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ১০ দশমিক ৯০ এবং অর্থবছর শেষে ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। সরকারি খাতে ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ এবং আগামী জুনে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা আগামী ডিসেম্বরে সাড়ে ৯ এবং জুনে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতদিন ‘মুদ্রা সরবরাহ টার্গেটিং’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছিল। তবে এবারের মুদ্রানীতির কাঠামোতে পরিবর্তন এনে করা হয়েছে ‘সুদহার টার্গেটিং’। এর মানে, মুদ্রানীতির মূল চালিকাশক্তি হবে সুদহার বাড়া-কমাকেন্দ্রিক। এ জন্য আন্তঃব্যাংক কলমানি থেকে ধারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সুদের একটি করিডোর দেওয়া হয়েছে। আগামীতে রেপোর সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ যোগ বা ২ শতাংশ বিয়োগ করে ব্যাংকগুলো কলমানির সুদ নির্ধারণ করতে পারবে। বাজারে উদ্বৃত্ত তারল্যের কারণে সর্বনিম্ন সুদেও কোনো ব্যাংক যখন টাকা খাটাতে পারবে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হারে সুদ দিয়ে ওই টাকা নিয়ে নেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা জানাচ্ছেন, ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। তখনকার বাস্তবতায় সেটা ঠিক ছিল। এখন এটা তুলে দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা অবশ্য স্বীকার করেছেন, সুদহার বাড়লে আমদানিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হয় এমন কোনো কিছু করা হবে না। তাঁদের মতে, বেসরকারি খাত যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকারি ঋণের বেশিরভাগই সরবরাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে অনেক টাকা উঠে আসছে। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা সরবরাহ না করলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট আরও বাড়ত বলে তাঁদের ধারণা।
গভর্নর অবশ্য স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো। বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আমদানি হ্রাস এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি কমেছে। তবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমা, পোর্টফোলিও বিনিয়োগ তুলে নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক মুদ্রার আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তাঁর আশা, আগামী অর্থবছর এটা সাড়ে ৩ বিলিয়ন উদ্বৃত্ত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য ১৮ বিলিয়ন হলে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য রয়েছে ৯ বিলিয়ন ডলারের মতো। চিকিৎসা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে প্রতি বছর অনেকেই ভারতে যান। শিগগির ‘টাকা পে’ নামে একটি কার্ড ইস্যু করা হবে। ওই কার্ড বাংলাদেশে ব্যবহার করা যাবে। আবার সরাসরি রুপি নিয়ে ভারতে গিয়েও খরচ করা যাবে। এতে ডলারের খরচ কমবে। আবার বিনিময় হারজনিত লোকসানও হবে না। এটি কার্যকর করা গেলে কিছুটা উপকার হবে বলেই আমার ধারণা।
এবারের মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। আগামী জুলাই থেকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হবে। তখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কম দরে ডলার দেবে না। অভিজ্ঞতা বলে, কাজটি যে সুকঠিন– তাতে সন্দেহ নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের মতে, এখনকার মূল্যস্ফীতি মূলত সরবরাহজনিত। বিশেষ করে আমদানি খরচ বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে। এটি সঠিক ধরে নিলে সরবরাহ বাড়াতে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বাড়ানো উচিত। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানোর ওপর জোর দেওয়া দরকার। এমনিতেই ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র, মাঝারির চেয়ে বড়দের বেশি ঋণ দিতে চায়। ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা কমানোয় এখন ছোটরা আরও কম ঋণ পাবে।
কেউ কেউ বলছেন, এবারের মুদ্রানীতিতে নীতির পরিবর্তন এসেছে, যা সামনের দিনগুলোতে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। তবে ২০২০ সালে দেওয়া সুদহারের সীমা কোনো সুফল বয়ে আনেনি– তা স্বীকার করা দরকার ছিল। আবার নতুন পদ্ধতিতে সুদহার আসলে কতটা বাজারভিত্তিক হবে, তা নিশ্চিত নয়। ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক এবং এক দর কীভাবে করা হবে, তাও দেখার বিষয়। বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। এর পেছনে হুন্ডির বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। হুন্ডির পেছনে রয়েছে এ দেশ থেকে টাকা পাচারের বড় ধরনের সংশ্লিষ্টতাও। এটা বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে মুদ্রানীতিতে কিছু বলা দরকার ছিল। যদিও আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সার্কুলারে আবারও ঋণখেলাপিদের জামাই আদর অনেকটা অব্যাহতই দেখছি।
আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঝেড়ে কাশার কোনো সুযোগ নেই বলেই প্রতীয়মান; এমনকি নির্বাচনকালীন আইএমএফের কথা শুনে জোরেশোরে সংস্কারেরও অবকাশ নেই; তাই মুদ্রানীতি কাজ করার সুযোগও এখানে অনেক কম।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক
- বিষয় :
- অর্থনীতি
- মামুন রশীদ