ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সংস্কৃতি

‘সাঁতাও’ সিনেমায় বাংলাদেশের গল্প

‘সাঁতাও’ সিনেমায় বাংলাদেশের গল্প

‘সাঁতাও’-এ ব্যারাজ, রানা প্লাজাই শুধু নয়; এনজিওর ঋণ, বাজার ব্যবস্থাসহ অনেক সংকট উঠে এসেছে, ছবি: সংগৃহীত

নাহিদ হাসান

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৩ | ০৪:৪৪

‘ও সখিনা গ্যাছোস কিনা ভুইল্যা আমারে/ আমি অহন রিশকা চালাই ডাহার শহরে’– ফকির আলমগীরের এই গান আবার ফিরে এলো সিনেমা হয়ে। কেন কৃষক দেশ ছাড়ে? কৃষকের কাছে দেশ হলো তার আকাশ; তার গ্রাম, নদী, প্রাণ-প্রকৃতি। প্রতীক ও বাস্তবতা দুই স্তরেই সিনেমাকে ক্রিয়াশীল থাকতে হয়। গ্রাম-শহর-বাইরের দুনিয়া মিলেও হতে হয় নির্দিষ্ট ও সর্বজনীন।

পরিচালক খন্দকার সুমন এমন একটি সিনেমা উপহার দিলেন, যা একই সঙ্গে আত্মপরিচয় সন্ধান এবং জাতি-রাষ্ট্রের সংকটকে চিহ্নিত করে। পরিচালক আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র মতো সিনেমা এ দেশে হয়েছে। আলমগীর কবীর, তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেলরা সমাজবদলকে চিত্রায়ণ করেছেন। সেটি ছিল গ্রামীণ শোষণ দেখানোর যুগ। কিছুটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপজাত হিসেবে কলকাতার নবজাগরণের দৃষ্টিভঙ্গিও। কিন্তু সম্ভবত জহির রায়হানের পর খন্দকার সুমনই দ্বিতীয় চলচ্চিত্রকার, যিনি চলতি রাষ্ট্রকে আনলেন। আনলেন পানি, বহুজাতিক পুঁজি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে। অনেকেই রাষ্ট্রকে এনেছেন অতীতে। কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে থেকেছে ইতিহাস হিসেবে।

“আল্লা! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চ’রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক’রো না।” (মহেশ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

গাঁয়ের মানুষের কাছে অবলা জীব মহেশ বা লালু গরু মাত্র নয়; আরেকটি সন্তান। জিডিপি আর মুদ্রাব্যবস্থা নদীকে বোন, পাহাড়কে ভাই, পৃথিবীকে মায়ের জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কসাই শুধু তিস্তাপাড়ের গাঁয়ে থাকে না; সীমান্তের ওপারেও থাকে। থাকে রাজধানীতেও।

খন্দকার সুমন একজন গল্পকার। তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের নারীদের মতো গীতের মধ্য দিয়ে, কান্নার মধ্য দিয়ে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। তেমনি গল্প খন্দকার সুমন সিনেমায়ও বলেন। একটা যাত্রাপথে অনেক ঘটনা তিনি বলেন। চলার পথে যে ঘটনাগুলো কৃষককে গ্রাম থেকে শহরে ছুড়ে দেয়। পরিণত করে ভাসমান শ্রমিকে।

২.

যে কৈশোরের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি, তা আমরা স্বপ্ন, ভাওয়াইয়া ও গীতে ফিরিয়ে আনি। ‘ও কী হায়রে হায়, মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়’– এ গানের বাকি কথাগুলো হেঁচকা টানে কৃষক সন্তানকে গাঁয়ে ফিরিয়ে নেয়। গ্রাম ছাড়ার বেদনায় তারা কেঁদে ওঠে। কিন্তু সেন্সরের সীমা তাঁকে গান আর ব্যারাজের দৃশ্য দেখিয়েই সরিয়ে নেয়। ধানে যখন দুধ আসে, তখন ব্যারাজের গেট খুলে আসা পানিতে ভেসে যাওয়ার দায় টানা বৃষ্টি ‘সাঁতাও’-এর ওপর চাপানো ছাড়া পথ থাকে না দর্শকের। অথচ কৃষকরা দুই মানুষ সমান উচ্চতার ধান আবাদ করত। পানি বাড়ার সঙ্গে ধানের চারাও বড় হতো। কিন্তু ব্যারাজের হঠাৎ আসা পানিতে এক রাতেই তো চারা দুই মানুষ হবে না। তবুও সিনেমার নাম ‘সাঁতাও’।

একইভাবে রানা প্লাজা ধসে যখন স্বজনরা লাশ হয়ে গ্রামে ফেরে, তখনও শুধু ধ্বস্ত ভবন আর কফিনে করে লাশ ফেরার ছবি। ৯টি কফিন ফিরে আসে গাঁয়ে। এ কফিন শুধু রানা প্লাজার নয়; কুমিল্লায় ইটভাটায় ট্রাক ব্রেক ফেল করে দুর্ঘটনায় লাশ হওয়া ১৩ জনের মধ্যে ৯ ছাত্রের লাশও বটে। আর ডিটেইল নেই। আমরা যেসব সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত, সেগুলোতে এক-দুটো সংকটকে ভিত্তি ধরে গল্প এগোয়। যেমন ‘জীবন থেকে নেয়া’য় পারিবারিক সংকট কিংবা ‘সারেং বৌ’-এ সুদখোর মহাজন। কিন্তু ‘সাঁতাও’-এ ব্যারাজ, রানা প্লাজাই নয়; এনজিওর ঋণ, বাজার ব্যবস্থাসহ অনেক সংকট এসেছে। পরিচালক যেন জীবনের শেষ সিনেমা করছেন বা শেষ ছবি আঁকছেন। তাই দুই ঘণ্টার একটি সিনেমাতেই সব জুড়ে দিয়েছেন। বাস্তব জীবন তো আসলে এমনই। জীবন নিটোল গল্প নয়। এভাবেই সেন্সরময় রাষ্ট্রে ইশারার পর ইশারা হাজির করেছেন। দর্শকরাও সম্ভবত পরিচালকের এ চাপ অনুভব করতে পারেন। দর্শকদেরও ঘুমের মধ্যে ইঙ্গিতগুলো ফিরে ফিরে আসে। শেষ দৃশ্যে নায়িকা ঘুমের মধ্যে যেমন নায়ক ফজলুকে হাতড়ে ফেরে; দর্শকরাও তেমনি হাতড়ান।

৩.

যতই সত্য হোক ঘটনা, তবুও তো সিনেমা। থাকে বাস্তব আর কল্পনার ভেদ। সিনেমাজগতে দাপিয়ে বেড়ানো পরিচিত নায়কের কারণে দর্শকের কাছে সিনেমা সিকি ভাগেরও কম বাস্তব মনে হয়। কিন্তু চরিত্রটিতে যখন অচেনা কেউ হাজির হয়, তখন সিনেমার ঘটনা সত্য হয়ে ধরা পড়ে। নায়ক ফজলুকে দেখে মনে হবে– এনাকে তো অষ্টমীর চরে দেখেছি; চিলমারীর জোড়গাছ গরুহাটিতে গল্প করেছি। অর্থাৎ নিজেকে শনাক্ত করতে পারছি। সত্য, অর্ধসত্য ছাপিয়ে নিজেকে পাওয়া যায়। ‘সাঁতাও’ সিনেমায় দর্শক সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান, যাঁরা বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিনেমাটির একের পর এক পুরস্কারপ্রাপ্তি প্রমাণ করে এর শিল্প-উত্তীর্ণতা। কিন্তু পরিচালক খন্দকার সুমন আমাকে বলেছেন, ‘শিল্পের মানদণ্ডের কোনো সীমা নেই। যা ঠারে ঠারে, ইশারায় বলতে চেয়েছি, তা দর্শক ধরতে পারছেন কিনা, এটা গুরুত্বপূর্ণ।’

দর্শকের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনার একটা খতিয়ান না নিয়ে সিনেমার বিশ্লেষণ শুরুই করা যায় না। ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ নিয়ে আলোচনায় এমনটা জানিয়েছেন কবি ফরহাদ মজহার। অবদমিত আকাঙ্ক্ষার বাংলা মানে কী? কীসের আকাঙ্ক্ষা? কার আকাঙ্ক্ষা? কোন শ্রেণির আকাঙ্ক্ষা? কোন সময়ের আকাঙ্ক্ষা? দর্শক পর্দায় ও পোস্টারে তার একটা ধারণা পান। তখনই আকাঙ্ক্ষার ধরন ও সীমা ঠিক হয়।

নাগরিক চোখে সিনেমাটিকে ডকুমেন্টারি মনে হবে। গীত ও নৌকাবাইচ নাগরিকের চোখে তাই। কিন্তু যে নারী বীজ রক্ষা করে, গরুর মতো অবলা জীবকে সন্তানতুল্য দেখে, যারা টাকার দুনিয়ায় থাকে না; তাদের কাছে এটি নিজেরই গল্প। তারা মৃতের পাশে আকাশ-পাতাল উথালও করে গীতের মাধ্যমে। তেমনি জীবনের গল্পও। গীত হলো অংপুরিয়াদের ভাষার নাম। পুরো সিনেমাতে তাই ঠারে ঠারে (সময়ে সময়ে) গীত হাজির হয়।

গ্রামে সিনেমা হল আর নেই। ফলে কৃষক রমণীর পক্ষে দল বেঁধে সিনেমা দেখার সুযোগও নাই হয়ে গেছে। কিন্তু শহরে তাদের যে সন্তানরা থাকে; বিপুল মুদ্রাস্ফীতির বছরেও তারা দুই সপ্তাহ ধরে হল ভর্তি রেখেছে। আর চিলমারীতে পণ্ডিত বইমেলার উন্মুক্ত প্রদর্শনীতে নারী দর্শকরা চোখের পানি মুছতে মুছতে পরিচালকের হাতে টাকা তুলে দিত না। বোঝা যায়, এ গল্প টাকার দুনিয়ার নয়; এ জীবন্ত মানুষের গল্প। ব্রহ্মপুত্র পাড়ের শিল্পী কছিম উদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও জলদেবতা মওলানা ভাসানীর দেশের আকাঙ্ক্ষিত সিনেমার নাম ‘সাঁতাও’।

নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক
[email protected]

আরও পড়ুন

×