ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

স্মরণ

অদম্য এক জননী

অদম্য এক জননী

জাহানারা ইমাম (১৯২৯–১৯৯৪)

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৩ | ০৪:৩৯

গতকাল ছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৪ সালের এই দিনে প্রায় আড়াই দশক ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারে ভুগে যুক্তরাষ্ট্রের এক হাসপাতালে মারা যান তিনি। আজন্ম যোদ্ধা এ মহীয়সী নারীকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
১৯৭০-এর দশকের শুরুতে তাঁর মুখে যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে, তখন এর চিকিৎসা ছিল না বললেই চলে। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই আক্রান্ত মানুষটিকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে হতো। কিন্তু জাহানারা ইমামের ছিল অদম্য এক মন। ফলে ক্যান্সার নিয়েই অসাধারণ এক কাজ করে গেছেন তিনি।

১৯৯১ সালে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীর আমির ঘোষিত হলে দেশে ছাইচাপা আগুনের মতো জনবিক্ষোভ তৈরি হয়। আরও কয়েকজনসহ জাহানারা ইমাম তা বুঝতে পেরে গঠন করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ক্যান্সারের কারণে কথা বলতে সমস্যা হতো তাঁর। এর পরও সবার অনুরোধে ওই কমিটির আহ্বায়ক হন তিনি। আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আওয়ামী লীগ, বাম ধারার প্রায় সব দলকে যুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হলে তারও আহ্বায়ক হন তিনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী মত পোষণকারী এসব দলকে এক ছাতার নিচে রাখার শারীরিক-মানসিক পরিশ্রমও করতে হয়েছে জাহানার ইমামকে। বলতে গেলে প্রায় একক হাতে। প্রচণ্ড শারীরিক ধকল সয়ে দেশের আনাচে-কানাচে সভা-সমাবেশও করেন তিনি। তাঁর নাম হয় শহীদ জননী।

এই কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালতের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমসহ বেশ কয়েকজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর প্রতীকী বিচার সম্পাদন করে। ওই গণআদালতের চেয়ারম্যান ছিলেন এরই মধ্যে শহীদ রুমীর মা থেকে সব মুক্তিযোদ্ধার মায়ে পরিণত হওয়া জাহানারা ইমাম। তৎকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল জামায়াতের প্রত্যক্ষ সমর্থনের ভিত্তিতে। ফলে তখন কী অপরিসীম চাপ তাঁকে সইতে হয়েছে, তা বোঝা দুরূহ নয়। জাহানারা ইমামসহ মোট ২৪ জনের বিরুদ্ধে তখন সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়, যার সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

আরেকটা কথা না বললেই নয়। সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সংসদে বিরোধীদলীয় সমঝোতার নামে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন প্রবল ঝুঁকিতে পড়ে। কিন্তু ক্যান্সার বেড়ে যাওয়ার কারণে জাহানারা ইমামকে চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হলেও তিনি অত্যন্ত ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আন্দোলনটি ধরে রাখেন। এমনকি দেশ শাসনকারী বড় দলের কোনো কোনো নেতানেত্রীর চাইতেও বড় হয়ে ওঠেন তিনি। সেই আন্দোলন পরে আর অবিতর্কিত থাকেনি। কিন্তু জাহানারা ইমাম রয়ে গেছেন শ্রদ্ধার আসনে।

জাহানারা ইমামের জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায়। চরম রক্ষণশীল পরিবারের গণ্ডি ভেঙে তাঁর আধুনিক এক নারী হওয়ার মধ্যেই বোঝা যায়, তিনি কোন ধাতুতে গড়া ছিলেন। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধে ছেলে এবং স্বামীকে হারিয়ে অধিক শোকে পাথর না হয়ে দেশ ও জাতিকে একাত্তরের কলঙ্কমুক্ত করার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন তিনি।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×