রা জ নী তি
জামায়াত কার ‘বি টিম’ কিছুদিন পর বোঝা যাবে

ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
দেশের বর্তমান ব্যবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, সেটি একটি বড় বিষয়। আশা করা যায়, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান আরও পরিষ্কার হবে শিগগিরই। কেননা নিয়ম অনুযায়ী আগামী নির্বাচনের সময় কাছাকাছি চলে এসেছে। বিএনপিকে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে, কারণ দলটি যেহেতু নির্বাচনের কথা বলে আসছে। আমাদের দেশের রাজনীতি যে ধরনের, তাতে নির্বাচনে কোনো দল না গেলে তখন হিসাবনিকাশ আলাদা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি কোন দিকে যাবে, সেটি এখন দেখার বিষয়। জামায়াত নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল না হলেও এখন তাদের নিবন্ধন বাতিল অবস্থায় রয়েছে, তাই তারা নির্বাচনে দলগতভাবে বা দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে পারছে না। যদিও দলটি তাদের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুসারে, দলীয়প্রধান নারী হতে পারবেন না। এটি বাংলাদেশের সংবিধানবিরোধী অবস্থান। দেশের সরকারপ্রধানও নারী হতে পারবেন না– এমনটা সেখানে বলা আছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে আরও যেসব অভিযোগ রয়েছে, তা ইতোমধ্যে বহু আলোচনায় এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতের দলীয় গঠনতন্ত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা, সেটিও দেখার বিষয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই (সপ্তাহ দুয়েকের) বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার কথা; যেহেতু আগামী নির্বাচন একেবারে কাছে চলে এসেছে। যদি জামায়াত তাদের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন না করে, সে ক্ষেত্রে কী ঘটে– সেটিও লক্ষণীয় বিষয় হবে। আমরা এরই মধ্যে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীদের অংশ নিতে দেখেছি। তাঁদের কেউ কেউ আবার জয়ী হয়েছেন– এটিও দেখা গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াত এভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে কিনা, তাদের প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ ঘটে কিনা– সেটিও এখন দেখার বিষয়। তবে প্রক্রিয়াটি নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি যাবে না– এর ওপর।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে যখন বলতে শুনি– জামায়াত হচ্ছে বিএনপির ‘বি টিম’, তখন সেটিকে শেষ পর্যন্ত আমি নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবেই চিহ্নিত করতে চাই। রাজনীতিতে এমন বক্তব্য আমরা অতীতেও বহু দেখেছি, শুনেছি। অন্যদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে শুক্রবার বললেন, সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট– সেটিও কৌতূহলোদ্দীপক। মাত্র কিছুদিন আগে সরকার যখন এক দশকেরও বেশি সময় পর জামায়াতকে সভা করার অনুমতি দেয় তখন ফখরুল বলেছিলেন– সবারই সভা– সমাবেশ করার অধিকার আছে; অনেকটা জামায়াতকে সমর্থন জুগিয়েছে তাঁর এ বক্তব্য। শুক্রবার যা বললেন তিনি তাতে অন্য কিছুর ইঙ্গিত মেলে।
ধরা যাক, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিল না এবং জামায়াতে ইসলামী তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রের কিছু অংশ বদল করল, তখন কী হতে পারে– এটিও ভাবা দরকার। রাজনীতিতে এর সবই সম্ভব। যদি সত্যিই এমন পরিস্থিতি চলে আসে তখন দেখা যাবে কে ‘এ টিম’ আর কে ‘বি টিম’। রাজনীতিতে এ ধরনের জল্পনাকল্পনা সব সময়ই ছিল।
জাতীয় পার্টির রাজনীতির দিকে তাকালে বিষয়টি বুঝতে কিছুটা সহজ হতে পারে। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পরে দলটি কোন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে? এরশাদের আমলের জাতীয় পার্টি আর জি এম কাদেরের আমলের জাতীয় পার্টি এক অবস্থায় নেই। এটি তো অস্বীকার করলে চলবে না।
দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃতীয় রাজনৈতিক দল ছিল জাতীয় পার্টি। আগামীতে জাতীয় পার্টির এই তিন নম্বর পজিশনে কে আসে, সেটিও দেখার বিষয়।
জামায়াতের রাজনীতি আগামীতে কোন দিকে যাবে, সেটি বোঝা যাবে বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাবে কি যাবে না– এটি দেখার ওপর।
একইভাবে আওয়ামী লীগ নিয়েও বলা যায়। আওয়ামী লীগের আমলে আমরা জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখে পড়তে দেখেছি। শুধু তা নয়, ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে জামায়াত নেতাদের অনেককে ফাঁসিতেও ঝুলতে হয়েছে এ সরকারের আমলে। এ সময়েই রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অকার্যকর হতে দেখেছি। এখন সেই আওয়ামী লীগ আবার জামায়াতকে নিয়ে কোন কৌশল অবলম্বন করে, সেটিও দেখতে হবে। আমি মনে করি, এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সামনে যে বড় চ্যালেঞ্জ তা হলো– আগামীতে এমন একটি নির্বাচন করা, যা সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সেই নির্বাচন আওয়ামী লীগকে করতে হবে, সেটিই বড় বিষয়। বর্তমান অবস্থায় বিএনপির যেসব দাবিদাওয়া, যদি তা আমলে আনা না হয়, সেই পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা– এটিও লক্ষণীয়।
বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে। আবার যদি বিএনপি আগামী নির্বাচন বর্জন করে, যেমনটা তারা ২০১৪-তে করেছিল, তাহলেও আওয়ামী লীগের জন্য অন্যরকম চ্যালেঞ্জ হবে। বিএনপির মতো একটি দল নির্বাচনে না গেলে মানুষ ভোট দিতে যাবে কিনা, সেটিও দেখতে হবে। এমনিতেই ভোটার উপস্থিতি দিন দিন কমে যাচ্ছে। আবার ভোটার উপস্থিতি থাকলেও তারা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে কিনা, এমন প্রশ্নও থাকবে। ভোট আয়োজনে বাধা দেওয়ার মতো দল বিএনপি এখনও হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সেটার লক্ষণ এখনই কিছুটা দেখা যায়। বিএনপি তাদের দাবির পক্ষে রাস্তায় এখনও লাখ লাখ লোক নামাতে পারেনি। আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক অতীত, তাতে দেখা গেছে লাখ লাখ লোক রাজপথে নামলে অবস্থার পরিবর্তন হয়।
এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ– আগামী নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য করা। কথা হচ্ছে, সেটি তারা কীভাবে করবে। সেখানে জামায়াতের রাজনীতি কিংবা বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক থাকা-না থাকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ– নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা।
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক