সাক্ষাৎকার: ড. এম সাখাওয়াত হোসেন
সরকার টিকে থাকলেই গণতন্ত্র হয় না

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মিজান শাজাহান
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ | ০৫:১৭
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (এসআইপিজি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো। ২০০৭-’১২ মেয়াদে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ১৯৯৫ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। গবেষণা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত এম সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ১৯৪৮ সালে, বরিশালের হিজলায়
মিজান শাজাহান: অনিয়ম বা বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন কোনো আসনের নির্বাচন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার ব্যাপারে সরাসরি ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিল। ২০০৮ সালে তৎকালীন শামসুল হুদা কমিশনের সময় অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা যুক্ত করা হয়েছিল। সেই কমিশনে আপনিও ছিলেন। তো ইসির ক্ষমতাহানিতে আপনার মূল্যায়ন কী?
সাখাওয়াত হোসেন: ইসির ক্ষমতা বলতে আর কিছু বাকি রইল না। নির্বাচন বলতে শুধু ভোট গ্রহণের দিনকে বোঝায় না। তপশিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফলের গেজেট হওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া নির্বাচনের মধ্যে পড়ে। শুধু ভোটের দিন অনিয়ম হলে আংশিক ভোট স্থগিত বা নির্দিষ্ট কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন শৃঙ্খলা আনতে পারবে বলে মনে করি না। আংশিক ভোট স্থগিতের সাহসও নির্বাচন কমিশন দেখাতে পারবে কিনা, জানি না। আসলে নির্বাচন কমিশন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। তারা যত কথাই বলুক; সাদা-কালোতে তাদের হাতে আর কোনো ক্ষমতা নেই। সরকার কেনই বা তাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিল– এ প্রশ্ন আমারও। যদিও কাজটি সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে করেনি। নির্বাচন কমিশন থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে করলে অনেক বিষয়েই হাত দিতে পারত।
সমকাল: দেখা গেল, ইসি নিজেই আইন মন্ত্রণালয়কে সুযোগ করে দিয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়ের সুবাদে যে ক্ষমতা কমিশনের এরই মধ্যে আছে, তার জন্য ইসি আইন মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী হলো কেন?
সাখাওয়াত হোসেন: আইন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিল বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য। কারণ বিধানটি আগেও ছিল। তবে এটি থার্ড ব্র্যাকেটে ছিল; বলতে পারেন, ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে ছিল। এবার এমনভাবে স্পষ্টীকরণ হলো যে, এটিকে ঐচ্ছিক থেকে বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে।
সমকাল: এই স্পষ্টীকরণ কি জরুরি ছিল?
সাখাওয়াত হোসেন: কীসের স্পষ্টীকরণ! ২০০০-’১৪ অর্থাৎ ১৪ বছর যে আইনে চলল, কোনো সমস্যা হলো না। আউয়াল কমিশনের আগে দুটি কমিশন দায়িত্ব পালন করেছে; তারা এটিতে হাত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। হঠাৎ কোথা থেকে বিশেষজ্ঞ এসে গেলেন, যাদের এটিতে সংশোধনী প্রয়োজন?
সমকাল: এটা কি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নেই– এ ধারণা তৈরি করে না?
সাখাওয়াত হোসেন: এ আইনের পরিবর্তনে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। ইসির উচিত ছিল বিলটি সংসদে উত্থাপিত হওয়ার পরই তাদের মতামত জানানো। বিলটি উত্থাপনের পর সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। স্থায়ী কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পর বিলটি সংসদে অবিলম্বে বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হয়। যদি নির্বাচন কমিশন চাইত, তাহলে স্থায়ী কমিটির কাছেও তাদের মতামত জানাতে পারত। আইন পাস হয়ে যাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কি কোনো লাভ হবে? যে ক্ষতি হয়ে গেল, তা থেকে উদ্ধার করবে কে? নির্বাচন কমিশনের সামনে এখন একটি পথ খোল– তারা চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিষয়টি তুলে ধরতে পারে। তারা সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ওখানে যাবে বলে মনে হয় না। আর গেলেও লাভ হবে না। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার সোমবার দাবি করেছেন, সংশোধনীর ফলে তাদের ক্ষমতা খর্ব হয়নি।
সমকাল: অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধায় উপনির্বাচন স্থগিতের পর সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন সাপের লেজে পা দিয়েছে। এখন সাপ না মারলে ছোবল দেবেই। নির্বাচন কমিশন কি সাপ মারতে পেরেছে?
সাখাওয়াত হোসেন: না; পারেনি। ওই সময় তারা অর্ধেক সফল হয়েছিল। বাকিটা না পারায় এখন ছোবল খেয়েছে। নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধার ব্যাপারে প্রথমে যে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল; সেই অবস্থান শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলে তার স্বাধীনচেতা মনোভাবের প্রতিফলন দেখা যেত। আসলে তারা গাইবান্ধায় অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন স্থগিত করে পরে সেই অবস্থানে অনড় থাকতে না পারায় হয়তো এবার ক্ষমতা হারিয়ে খেসারত দিচ্ছে।
সমকাল: আরপিও সংশোধনীর মাধ্যমে এটা কি বোঝা গেল যে, সরকার ইসির স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত নয়? আবার বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বলছে– নির্বাচন কমিশন কী করল তা মুখ্য নয়; এই সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে তাই কোথায় জোর দেওয়া দরকার?
সাখাওয়াত হোসেন: আমি বিলটি পড়েছি। নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রের ভোট বন্ধ বা স্থগিত করা কোন সময়ের জন্য প্রযোজ্য হবে, তা উল্লেখ নেই। আইনে অস্পষ্টতা যদি থেকেই যায়, তাহলে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা হবেই। আমি আইনজ্ঞ নই। তবে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আইন প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আরপিওতে আইনি ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দরকার ছিল। তাহলে অস্পষ্টতা দূর হতো।
সমকাল: আইনের এ সংশোধন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে?
সাখাওয়াত হোসেন: অবশ্যই প্রতিবন্ধক হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইন মুখ্য বিষয়। যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন; আইনে ফাঁকফোকর থাকলে সুফল কম আসবে। বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা হলে সেই আইন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিনা– এ প্রশ্ন জাগতেই পারে। আইনের মাধ্যমে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। তাই সব রাজনৈতিক দলের বলা উচিত– ইসির ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। যদিও সরকার দুঃখ প্রকাশ করে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেবে না। এমন নজির নেই। এটি বর্তমান সরকার কেন; অতীতের সরকারও করত না। ভবিষ্যতে নতুন নির্বাচন কমিশন এসে হয়তো ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে।
সমকাল: বিএনপি বলছে– তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে– সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। সংলাপ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। বিএনপি এক দফা ঘোষণা করবে। পরিণতি কী হতে পারে?
সাখাওয়াত হোসেন: হয়তো বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। পুনরায় একতরফা নির্বাচন হবে। অতীতের দুটি নির্বাচন যেমন হয়েছে, তেমন আরেকটি নির্বাচন হবে। জনগণ কতটুকু গ্রহণ করবে– সেটিই বিষয়। সরকারও টিকে থাকবে। সরকারের টিকে থাকা আর গ্রহণযোগ্যতা এক নয়। পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচন ছাড়াই সরকার গঠিত হয়। সরকার টিকে থাকলেই গণতন্ত্র হয় না। গণতন্ত্রে সব নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হয়। তা না হলে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া যায় না। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে নির্বাচনে ব্যাপক গন্ডগোল হয় না। কিন্তু সেখানে নানা কারণে গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেকেই সামরিক সরকারকে মুখস্থ গালি দেয়। তিন দশক ধরে গণতান্ত্রিক সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এখানে টাকা ছাড়া দলীয় মনোনয়ন মেলে না। নির্বাচন করতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করতে হয়। ২০ কোটি টাকা খরচ করে সংসদ সদস্য হলে তিনি কী আর সেবা করবেন? তিনি তো টাকা তোলার ধান্ধায় থাকবেন। কালো টাকার ছড়াছড়ি বন্ধ করা দরকার। এখন সংসদে রাজনীতিবিদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ত্যাগী লোকের বড়ই অভাব। সংসদে কয়জন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ আছেন? আগে নেতারা ডাক দিলে হাজার হাজার কর্মী ছুটে আসত। এখন টাকা, খাবার না দিলে লোক যায় না। এ দায় কাদের? অবশ্যই রাজনীতিবিদদের।
সমকাল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি দিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে কূটনৈতিক তৎপরতাও বেড়েছে।
সাখাওয়াত হোসেন: অতীতের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি বলেই বিদেশি তৎপরতা বেড়েছে। বিদেশিদের মধ্যে আবার পক্ষ-বিপক্ষ আছে। কেউ সরকারের পক্ষে, কেউ বিরোধীদের। আমরা দড়ি টানাটানির মাঝখানে পড়ে গেছি। আরও পরিষ্কার করে বললে, আমরা আন্তর্জাতিক খেলার মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা এখন আর সত্তর দশকের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ নই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। যখন অসচ্ছল ছিলাম, তখন এত দিকে নজর না দিলেও চলত। এখন বুঝে পথ চলতে হবে। ভুল পথে হাঁটলে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার মুখে পড়তে হবে।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সাখাওয়াত হোসেন: সমকালের জন্য শুভকামনা।
- বিষয় :
- ড. এম সাখাওয়াত হোসেন