ভূরাজনীতি
যুক্তরাষ্ট্রের ভুল শোধরাতেই কিসিঞ্জার চীনে

শি জিনপিংয়ের সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জার-সংগৃহীত
পেপ এসকোবার
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
আনুষ্ঠানিকতার প্রতি চীনারা একটু বেশিই যত্নবান। তারই আদলে হেনরি কিসিঞ্জার রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা ভিলা ৫-এ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। এটি সেই জায়গা, যেখানে কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালে স্বয়ং প্রথমবারের মতো চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেবারের সাক্ষাতের উপলক্ষ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ১৯৭২ সালের চীন সফরের প্রস্তুতি।
এবারের মি. কিসিঞ্জারের বেইজিং সফরকাণ্ডটা ছিল ‘বেসরকারি’। চীন-আমেরিকা সম্পর্কের বাড়তে থাকা ফাটল মেরামতের এক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। এই দফায় তিনি আর মার্কিন প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করছেন না।
এখানে একটা মোচড় আছে। ভূ-রাজনীতিতে জড়িতমাত্রই কিসিঞ্জারের বিখ্যাত সমীকরণটা জানেন: যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, আর বন্ধু হওয়া মারাত্মক। ইতিহাসে এর বিস্তর উদাহরণ মিলবে। জাপান থেকে দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে জার্মানি, ফ্রান্স ও হালের ইউক্রেন।
বেশ কয়েকজন চীনা পণ্ডিত একান্তে জানিয়েছেন, যুক্তি মানলে এবং ‘শতবর্ষী মার্কিন কূটনীতিকের প্রতি সম্মান জানিয়ে বললে, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যেমন আছে তেমনটাই থাকা উচিত: বরফতুল্য। তাদের যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হওয়া ভয়ঙ্কর হলেও চীনের মতো সার্বভৌম সভ্যতার পক্ষে সেই ঝুঁকি সামলানো কঠিন নয়। তাই বেইজিংকে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ‘মর্যাদাপূর্ণ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা’ বজায় রাখা উচিত।
বর্তমান আমেরিকান প্রশাসন কিসিঞ্জারের মতো উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির শান্তি উদ্যোগের ধার ধারে না। তারা বরং যুদ্ধংদেহী এডওয়ার্ড লুটওয়াকের নীতি অনুসরণ করে। ৮০ বছর বয়সী লুটওয়াক কিসিঞ্জারের মতো দৃশ্যত এতটা প্রভাবশালী নাও হতে পারেন। কিন্তু গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে পেন্টাগন পর্দার আড়ালে তাঁরই নীতি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কৌশল নিয়ে তাঁর লেখা বইটি মূলত ইতালীয় ও ব্রিটিশ সূত্রনির্ভর হলেও ক্লাসিকের মর্যাদা পায়। লুটওয়াক ধাপ্পাবাজির ওস্তাদ। ওয়াশিংটনের বর্তমান কার্যকলাপ এই কৌশলের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। এখন যেমন বাইডেনের দলবল বোঝাতে চাইছে– রাশিয়ার সঙ্গে তারা একটা বন্দোবস্তে আসতে চায়।
লুটওয়াক বলছেন, শি জিনপিং ‘যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন’। কিন্তু তিনি সম্ভবত শি জিনপিংয়ের ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’র চেষ্টা বুঝতে পারেননি। যেমন শি জিনপিংয়ের ‘চীনের পুনরুজ্জীবন’-এর ধারণাও ভুল বুঝেছেন। লুটওয়াক মনে করেছেন, পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হলে চীনেক যুদ্ধ বাধাতে হবে। বাস্তবে পুনরুজ্জীবন নয়, কথাটা হবে পুনর্জাগরণ। অন্তত ১৯১১ সালে কিং রাজবংশের উৎখাতের পর থেকে এটি চীনের সর্বত্র অনুরণিত হচ্ছে৷ এটা শি তৈরি করেননি। চীনা পণ্ডিতরা উল্লেখ করেছেন, আপনি যদি মার্কিন সৈন্যদের তাইওয়ানে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে আসতে দেখেন, তবে আপনি সম্ভবত যুদ্ধের প্রস্তুতিও নেবেন।
আসলে লুটওয়াকের একটা মিশন রয়েছে, যা তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট: ‘আমি আমেরিকা, ইউরোপ, ইউক্রেন, রাশিয়া সম্পর্কে বলছি না। আমি বলছি একমাত্র একনায়ক সম্পর্কে। তিনি শি জিনপিং।’ লুটওয়াক কয়েকটি শব্দে পুরো খেলাটি ব্যাখ্যা করেন: ‘রাশিয়ান ফেডারেশনের যে অবস্থা, তারা চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।’ তাঁর মতে, চীন যদি হুমকি হয়, তবে আপনি রাশিয়াকে ভেঙে পড়তে দিতে পারেন না।
কিসিঞ্জারি কূটনীতির একেবারে দফারফা করে দিয়েছেন লুটওয়াক!
দু্ইজনের কূটনৈতিক ভাবনায় এমন ফারাক এমন সময়ে বেরিয়ে আসছে, যখন আমেরিকান সাম্রাজ্য অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। সেখানে ইউ-টার্ন চলছে বা অন্তত ইউ টার্নের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন মূলধারার মিডিয়া সম্পূর্ণভাবে ইউ টার্নের পেছনে থাকবে। সাধারণ মানুষও তা অনুসরণ করবে। লুটওয়াক ইতোমধ্যে তাদের গভীরতম এজেন্ডা প্রকাশ করছেন: চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধই আসল যুদ্ধ এবং চীন তাতে ‘হারবে’।
বাইডেনের আশপাশে অন্তত নয়া রক্ষণশীলদের বাইরেও কিছু লোক আছে, যেমন বার্নস। তারা কিয়েভের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রায় চিরস্থায়ী হাইব্রিড যুদ্ধের কৌশলগত ভুল বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে। এর অর্থ হলো, ওয়াশিংটন ভিয়েতনাম এবং আফগানিস্তান থেকে যেভাবে পালিয়ে গেছে, অন্তত নীতিগতভাবে কিয়েভ থেকে সেভাবে সরে যেতে পারে না। তবে চাইলে তারা চলে যেতে পারে। কারণ তাদের অনুচর রাষ্ট্রগুলোর না থাকলেও অন্তত আমেরিকার সার্বভৌমত্ব আছে। ইউরোপীয় অনুগতরা এখানেই পচে মরবে। বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো রাশিয়া-চীনের বিরুদ্ধে একাই যুদ্ধ ঘোষণা করছে। লুটওয়াকের তৎপরতা এটা বোঝায়, ওয়াশিংটন ইউক্রেনে এক ধরনের ‘নৈতিক বিজয়’ অর্জন করেছে। এখন তারা চীনের দিকে বন্দুক তাক করতে পারে। তবে এটি সহজ হবে না। কারণ চীন এবং সম্প্রসারিত হতে যাওয়া ব্রিকস ইতোমধ্যে আমেরিকান সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এর ফলে ডলারের আধিপত্যে টান পড়ছে। চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে এ অবস্থায় আমেরিকাকে নিজের পকেট থেকেই যুদ্ধের অর্থায়ন করতে হবে। চীনা পণ্ডিতরা তাদের সহস্রাব্দপ্রাচীন বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে অফ দ্য রেকর্ড বলেছেন, এটি হবে আমেরিকান সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের শেষ ভুল। তাদের মধ্যে একজন এর সারমর্ম হিসেবে বলেছেন, আমেরিকান সাম্রাজ্য অস্তিত্বের যুদ্ধে বড় ভুল করছে। চীনের সঙ্গে যুদ্ধ হবে তাদের শেষ যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষ হলে আমেরিকা যথারীতি মিথ্যা বলবে এবং নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করবে। কিন্তু অন্য সবাই সত্যটা জানবে, বিশেষ করে তাদের অনুগতরা।
রাশিয়া-চীনের কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক আজ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় আধিপত্যবাদকে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করতে সক্ষম। মাইকেল হাডসনের প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মুনাফা এবং দক্ষতা বিশ্ববাণিজ্য নির্ধারণ করবে কিনা। বিনিয়োগের ধরন নির্ধারণ করবে, কে এগিয়ে থাকবে। নাকি শিল্পোত্তর মার্কিন/ন্যাটো অর্থনীতি দ্রুত জনসংখ্যাহীন এবং বিশিল্পায়িত ইংল্যান্ড বা সেভিয়েত-উত্তর ইউক্রেন ও বাল্টিক রাস্ট্রগুলোর চেহারা নেবে।
তাহলে কি চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দিবাস্বপ্ন এই ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তন করতে চলেছে? বিশ্ব কি তাহলে থুসিসাইডিসের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে? যেখানে উঠতি বিশ্বশক্তির সঙ্গে বিদ্যমান বিশ্বশক্তির যুদ্ধের অনিবার্যতার কথা বলা হয়। বলাবাহুল্য, প্রকৃত যুদ্ধ ইতোমধ্যে চলছে। তবে সেটি নিশ্চিতভাবে কিসিঞ্জার, ব্রজিনস্কি, লুটওয়াক এবং মার্কিন নব্য রক্ষণশীলদের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়নি। মাইকেল হাডসনের কথা দিয়েই শেষ করি, অর্থনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ বিশ্ব থেকে এতটাই বিচ্ছিন্নতার কৌশল নিয়েছে যে, এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো বিশ্বযুদ্ধের সমতুল্য।
পেপ এসকোবার: ব্রাজিলিয়ান ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এশিয়া টাইমসের এডিটর অ্যাট লার্জ; দ্য স্পুটনিক নিউজ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
- বিষয় :
- ভূরাজনীতি
- পেপ এসকোবার