কম্বোডিয়া
কম্বোডিয়া কর্তৃত্ববাদের আদর্শ মডেল

কম্বোডিয়ার নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন হুন সেন - এএফপি
লি মর্গেনবেসার
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন তাঁর দল কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন। সে সভায় তাঁর বড় ছেলে হুন মানেট সর্বসম্মতভাবে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ছেলের বয়স এখন ৪৫, আর বাবার বয়স ৭০। তাদের দল ১৯৭৯ সাল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটি শাসন করছে।
পুরো নির্বাচনটি নিপীড়িত নাগরিকদের ওপর রাজনৈতিক বাস্তবতা চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল। এটা হুন সেনের বিশাল আত্মবিশ্বাসের প্রদর্শনী ছাড়া আর কিছু নয়। নির্বাচন প্রক্রিয়াটি জনগণের সম্মতি ছাড়াই প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং তাদের অনুমোদন ছাড়াই প্রয়োগ করা হয়েছিল।
হুন সেনের ছেলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এখন নিশ্চিত। একমাত্র প্রশ্ন হতে পারে, কখন তা ঘটবে। শক্তিশালী ব্যক্তিটি অবশ্য গত সপ্তাহে বলেছিলেন, এটি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ঘটতে পারে। এই বছরের নির্বাচনে প্রচারাভিযান ছিল আগের চেয়েও অস্বাভাবিক কারচুপি এবং অসদাচরণযুক্ত, যার সব ক’টির লক্ষ্য ছিল ব্যালট বাক্সে কিছু বিস্ময়ের নিশ্চয়তা দেওয়া। মে মাসে জাতীয় নির্বাচন কমিটি নেতৃস্থানীয় বিরোধী ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেয়। কারণ এটি নাকি প্রয়োজনীয় নথিপত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরিহাসজনক হলো, এসব নথিপত্র কয়েক বছর আগে একটি পুলিশ অভিযানের সময় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
জুনের গোড়ার দিকে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনী আইন সংশোধন করে অ-ভোটারদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিষিদ্ধ করে। সেই সঙ্গে নির্বাচন বর্জন আহ্বানকারীকেও শাস্তির আওতায় আনে। নতুন বিরোধী শক্তির জন্য প্রহসনমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়া উন্মোচনের লক্ষ্যে বর্জন ছিল তাই অভিনব ও মরিয়া এক কৌশল।
জুনের শেষ দিকে ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটার সঙ্গে হুন সেনের প্রকাশ্য বিবাদ বাধে। কারণ মেটার তদারকি বোর্ড রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে হুন সেনের অ্যাকাউন্ট স্থগিতের সুপারিশ করে এবং গত সপ্তাহে সরকার রেডিও ফ্রি এশিয়াসহ বেশ কয়েকটি সংবাদ সংস্থার ওয়েবসাইট ব্লক করে। হুন সেনের কম্বোডিয়ায় এটি ছিল একেবারেই সাধারণ বিষয়। তবে অস্বস্তিকর সত্য হলো, এ ধরনের নির্বাচন হুন সেনের জন্য বিরোধীদের ক্ষমতা লাভের সুযোগের বিপরীতে চিরকাল শক্ত-পোক্তভাবে ক্ষমতায় থাকার উপায়ের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। ১৯৮৫ সালের জানুয়ারিতে দখলদার ভিয়েতনামি বাহিনী তাঁকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পর থেকে বয়স্ক শক্তিশালী ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তাঁর ইচ্ছাপূরণের প্রক্রিয়ায় পরিণত করেন।
কীভাবে তিনি গত ৩৮ বছরে এই কীর্তি সম্পন্ন করলেন? কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে আমার গবেষণার ওপর ভিত্তি করে দুটি উল্লেখযোগ্য কারণ পেয়েছি। ক্যামেরুনে পল বিয়া, ইরাকে সাদ্দাম হোসেন এবং উগান্ডার ইদি আমিনের মতো অন্যান্য শক্তিশালী ব্যক্তির দেখানো পথ অনুসরণ করে হুন সেন প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো ক্ষমতার ব্যক্তিগতকরণ। চার দশকজুড়ে কর্তৃত্ববাদ তাঁর কর্মের মধ্যে ছিল। সেই প্রক্রিয়ার একজন দারোয়ান হিসেবে কাজ করা, যার মাধ্যমে লোকেরা উচ্চ পদে নিযুক্ত হয়; দল, সামরিক বাহিনী ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পদে আত্মীয়দের নিয়োগদান; রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং সামরিক কমান্ডের সাধারণ চেইনের বাইরে নিজস্ব আধা-সামরিক গোষ্ঠী তৈরি; ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরোপের পাশাপাশি এর কার্যনির্বাহী কমিটিতে কে ঢুকবে এবং কে তা থেকে বেরিয়ে যাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা।
২০০৫ সাল নাগাদ কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কর্মী নিয়োগ নীতি এবং হালুয়া-রুটি বিতরণ বিষয়ে হুন সেন বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হন। দ্বিতীয় যে কাজটি তিনি করেছেন তা হলো, কম্বোডিয়ায় কঠোর একনায়কত্ব প্রবর্তন। যার ফলস্বরূপ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি একটি সত্যিকারের একদলীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে সরকার একটা বিল পাসের মাধ্যমে সুশীল সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আইনের মাধ্যমে তাদের ক্রিয়াকলাপ সীমিত করতে তহবিল, প্রতিবেদন, নিবন্ধন এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বিষয়ে অত্যাশ্চর্য সম্মতি নেওয়ার চেষ্টা চলে। তার পর ২০১৭ সালের আগস্টে অর্থ মন্ত্রক এক দশকের কথিত বকেয়া কর আদায়ের নামে ইংরেজি ভাষার নিরপেক্ষ সংবাদপত্র দ্য কম্বোডিয়া ডেইলির পিছে লাগে। এটি ছিল কম্বোডিয়াকে স্বাধীন গণমাধ্যমমুক্ত করার লক্ষ্যে টেকসই প্রচারণার সূচনা মাত্র। তার পর সুপ্রিম কোর্ট ক্ষমতাসীন দলের একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টিকে বিলুপ্ত করে দেন এই কাল্পনিক অভিযোগে যে, এটি ‘রঙিন বিপ্লব’-এর মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করছে। যিনিই যখন হুন সেনের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধেই তিনি বারবার এ অভিযোগ তুলেছেন। এই পটভূমিতেই হুন সেন রোববার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেষ জাল নির্বাচন প্রক্রিয়ার অনুমোদন দিলেন।
রাজনৈতিক বিরোধীরা এখন নির্বাসনে; মিডিয়া ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে; সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো ক্ষমতাহীন; গণবিক্ষোভ দমিত এবং নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা নির্বিচারে খর্বিত। অতএব হুন মানেটের জন্য হুন সেনের উত্তরাধিকারী হওয়ার পথ এখন পরিষ্কার। তো, এর পর কী হবে?
নেতৃত্ব হস্তান্তর একনায়কতন্ত্রের জন্য অ্যাকিলিস হিলও হয়ে যেতে পারে। প্রক্রিয়াটি কখনও কখনও রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বকে উস্কে দিতে পারে এবং সম্ভাব্যরূপে একটি দেশকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিমজ্জিত করতে পারে। এ বিষয়গুলো থেকে এটা বলা যায়, চারটি পূর্বশর্ত পূরণ হলে শক্তিশালীদের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়: ১) দায়মুক্তি, যা দায়িত্বে থাকাকালীন সংঘটিত যে কোনো অপরাধের জন্য তাদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করে; ২) নিরাপত্তা: নিরাপত্তা ব্যবস্থার শীর্ষ পদ দখলে কিংবা একটি আধা-সামরিক বাহিনী তৈরির মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা; ৩) সম্পদ: অবসর গ্রহণের পরও তাদের কাছে প্রচুর নগদ অর্থ বা তেমন কোনো ব্যবস্থা থাকে; ৪) আস্থা: তারা এমন কাউকে নিয়োগ করে যে তাদের দায়মুক্তি, নিরাপত্তা এবং সম্পদের প্রাচুর্য নিশ্চিত করতে পারে। এখন পর্যন্ত দায়মুক্তি ব্যতীত এ সব নিয়ে হুন সেন তাঁর ছেলের হাতে ক্ষমতা দিতে উপযুক্ত অবস্থানে রয়েছেন। এ মুহূর্তে দায়মুক্তির অবশ্য প্রয়োজনও নেই। সাধারণত, যখন একনায়কতন্ত্রে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, তখন নতুন শক্তিশালী ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্র ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে এক ধরনের সুবিধা পান এ আশায়: নিশ্চয় তিনি আগের জনের চেয়ে খারাপ হতে পারেন না। হুন মানেটও হয়তো, যিনি ওয়েস্ট পয়েন্টে ইউনাইটেড স্টেটস মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষিত; ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি পেয়েছেন, এ সুবিধা পাবেন। তবে ইলহাম আলিয়েভ (সাবেক আজারবাইজানীয় নেতা হায়দার আলিয়েভের ছেলে), বাশার আল-আসাদ (সিরিয়ায় হাফেজ আল-আসাদের ছেলে), জোসেফ কাবিলা (কঙ্গোতে লরেন্ট কাবিলার ছেলে) এবং কিম জং উনের (উত্তর কোরিয়ায় কিম জং ইলের ছেলে) মতো অন্য শক্তিশালীদের ছেলেদের অনুরূপ; হুন মানেট তাঁর পিতার বর পেয়েছেন। অতএব কম্বোডিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর আস্তিনে কোনো জাল নির্বাচন নেই– এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
লি মরগেনবেসার: গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক; দি কনভারসেশন থেকে ভাষান্তরিত