নির্বাচন
বিদেশিরা নয়, সমাধানের দায়ভার জনগণের

ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৩ | ০৬:১৫
চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। এর আগেও সিইসি সংলাপের কথা বলেছেন। কিন্তু মঙ্গলবার সংলাপের কথা তিনি বলেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর। সংবাদমাধ্যম যেভাবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে খবর করেছে; অনেকে ভাবতে পারেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রথমবারের মতো বুঝি সিইসি সংলাপের কথা বললেন। শুধু সিইসি নন; অনেকেই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের কথা বলছেন। কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে সংলাপের মাধ্যমে খুব কম সমস্যারই সমাধান হয়েছে। এমনকি বিদেশিদের ভূমিকায়ও সমাধান আসেনি।
তার পরও সংলাপের কথা যদি বলি, এবার তা কীসের ভিত্তিতে হবে? আমরা দেখছি, নির্বাচন নিয়ে বড় দলগুলোর অবস্থান একেবারেই বিপরীতমুখী। বিরোধী দল দাবি করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে। আর ক্ষমতাসীন দল বলছে, এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান সংশোধন করে ইতোমধ্যে তা বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং সরকার যে কাঠামো দাঁড় করাচ্ছে, সেভাবেই নির্বাচন হবে। আমি একজন একাডেমিশিয়ান হিসেবে মনে করি এবং ইতিহাসও তার সাক্ষ্য দিচ্ছে, জনগণই সমস্যার সমাধান করেছে। জনগণ রাস্তায় নেমে সমাধান করেছে। সে হিসেবে বিরোধী দল দেখাতে চাচ্ছে, তাদের সঙ্গে জনগণ আছে। আবার সরকারি দলও বসে নেই। তারাও দেখাচ্ছে, জনগণ তাদের দিকে। এ জন্য পাল্টাপাল্টি অবস্থা দেখছি। যদিও একে পাল্টাপাল্টি বললে ভুল হবে। কারণ, এখন থেকে নির্বাচনী তপশিল ঘোষণা পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই উভয় দল তাদের সমর্থন প্রদর্শন করতে চাইবে। তার মানে, এভাবে সমাধান হবে না। তপশিল ঘোষণা হয়ে গেলে তখন দেখা যাবে, বিরোধী দল নির্বাচনে যায় কিনা। যদি যায়, তখন এক ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করবে। আর না গেলে অন্য ধরনের অবস্থা দেখা যাবে। কিন্তু সব সমস্যার সমাধান জনগণেরই হাতে। আমি মনে করি, সংলাপের যে কথা বলা হচ্ছে, তাতে সমাধান আসবে না। একইভাবে বিদেশিরা যে কথাবার্তা বলেন, তার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কোনো উপকার হয়েছে– এমন নজির পাওয়া যায় না।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বিদেশিদের আসা-যাওয়া তত বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়েই এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা এসে গেছেন। এর পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল এসেছে। তাদের এই আসার কারণ হলো, তারা সুযোগ পেয়েছে। তাদের এখানে আসা, নানা বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ আমরাই দিয়েছি। আমরা এমনভাবে তাদের প্রশ্ন করছি, যেন তাদের বিশেষ কোনো ভূমিকা রয়েছে। আমি সব সময় বলছি, জনগণই সমস্যার সমাধান করেছে। কিন্তু আমাদের সংবাদমাধ্যম যতখানি না জনগণের কাছে যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি যাচ্ছে বিদেশিদের কাছে। এতে তারা সুযোগ পাচ্ছে। কারণ, তাদের খবর সামনের পাতায় বড় করে ছাপা হয়। কোন দেশে তারা এমন গুরুত্ব পায়, আমার জানা নেই। মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন তাদের খবর ও ছবি প্রকাশ হওয়ায় তারাও পেয়ে বসেছে। তাদের দিক থেকে নিশ্চয় অন্য বিষয় আছে। যেহেতু এখানে তাদের বিনিয়োগ আছে, সে চিন্তাও তারা করে। তবে বিষয়টি সরলরৈখিকভাবে দেখার সুযোগ সামান্যই।
অনেকে এও বলছেন, এখন বিরোধী দল যেভাবে সভা-সমাবেশ করছে, আন্দোলনের পরিবেশ পাচ্ছে, তার সঙ্গে মার্কিন ভিসা নীতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি না, ভিসা নীতির কারণেই তারা এই সুযোগ পাচ্ছে। যেহেতু নির্বাচন কাছাকাছি চলে আসছে, সে জন্য তারা স্বাভাবিকভাবেই মাঠে আছে। বিশেষ করে গত দুটি নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সমালোচনা রয়েছে– তা অস্বীকার করলে চলবে না। ওই ঘাটতির কারণেই সরকার অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের দেশে মিছিল-মিটিংয়ের যে সংস্কৃতি রয়েছে, তা ফিরিয়ে আনছে। অনেক দেশে তো মিছিল-মিটিং হয় না। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে মিছিল-মিটিং দেখা যায় না। সংবাদমাধ্যম থেকেই তারা সবকিছু বুঝে নেয়। একেক দেশে একেক সংস্কৃতি। আমাদের দেশে যেহেতু মানুষ নির্বাচনের আগে রাস্তায় নামে; সরকারও ভাবছে, এ সময় মিছিল-মিটিং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ এ সময় সরকারও বলছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়। আগের নির্বাচনগুলোতে যে ঘাটতি ছিল, সেগুলোও তারা আর দেখতে চায় না।
এমন নয় যে, বিরোধী দলকেই তারা মাঠ ছেড়ে দিচ্ছে। বিরোধী দল যে একাই মিছিল-মিটিং করছে, তা-ও নয়। ক্ষমতাসীন দলও সভা-সমাবেশ করছে। তাদের কর্মসূচি দিচ্ছে। অযথা ভিসা নীতির কথা বললে বিদেশিরা আরও পেয়ে বসে। তখন তারা ভাবে, আমাদের জন্যই এমনটা হচ্ছে, তা আমি মনে করি না। বাংলাদেশে রাজনীতি যারা করেন, তারা খুব সচেতন। অন্য দেশ কী করল না-করল, সেটা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি হবে– এটা ঠিক নয়।
আমি আবারও বলছি, বিদেশিদের সুযোগটা আমরাই দিচ্ছি। এখানে এককভাবে মিডিয়ার দোষ যে রয়েছে, তাও নয়। আমাদের একাডেমিশিয়ানরা এমনকি রাজনৈতিক দল– যারাই বিরোধী দলে ছিল, তারাই বিদেশিদের কাছে গেছে বা যাচ্ছে। তবে অস্বীকার করলে চলবে না, মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। বিদেশিরা এখানে আসছে, কারণ এখানে তাদের নানাবিধ স্বার্থ আছে। তাদের ব্যবসা, ভূ-রাজনীতি মিলে তাদের একটা বড় স্বার্থ রয়েছে। তাদের মতো কাঠামো তৈরি করতে পারলে তাদেরও সুবিধা। সে জন্য তারা এখন দৌড়ঝাঁপ করছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে এটা স্পষ্ট, এখন থেকে তপশিল পর্যন্ত বিরোধী দল মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে দেখাতে চেষ্টা করবে, জনগণ তার পক্ষে আছে। কিন্তু সরকারও যেভাবে দেখাতে চাচ্ছে– তার পক্ষেও জনগণ আছে, সেটাই এবার ব্যতিক্রম। তবে বিরোধী দল যে খুব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পথে এগোবে, তেমনটা মনে হচ্ছে না। কারণ তারাও জানে, এতে তার প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের যে সহানুভূতি আছে, তা-ও থাকবে না। সেটা ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়েছে কানাডার আদালতের রায়ে। সেই রায়ে সন্ত্রাসের কথা বলেনি বটে, কিন্তু যেভাবে ‘সাবভার্সন বাই ফোর্স’ বলা হয়েছে, তা কিন্তু কম কঠিন নয়। অর্থাৎ একটা সরকারকে জোর করে উৎখাতের চেষ্টা। স্বাভাবিক সাবভার্সনই এখন অনেক দেশে বেআইনি। সে জন্য জনগণই শেষ ভরসা হওয়া উচিত।
ইমতিয়াজ আহমেদ: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- নির্বাচন
- ইমতিয়াজ আহমেদ