ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ভূরাজনীতি

ব্রিকসে বাংলাদেশ নেই কেন?

ব্রিকসে বাংলাদেশ নেই কেন?

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৩ | ০৮:২৬

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি চর্চিত বিষয়, নিঃসন্দেহে, ব্রিকসের নতুন সদস্য তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকা। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির এ জোটের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলনে ছয়টি দেশকে এর সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রত্যাশা জাগিয়েও বাংলাদেশ সেখানে স্থান করে নিতে পারেনি। এটা যেমন সরকার সমর্থকদের জন্য কিছুটা হলেও হতাশার বিষয়, তেমনি বিরোধী শিবিরের জন্য একপ্রকার মওকা। সরকার সমর্থকরা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, ভূরাজনৈতিক কৌশলের কারণে– বিশেষত আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে সরকারের চলমান টানাপোড়েনের মধ্যে– বাংলাদেশ সরকার নিজেই ব্রিকসে ঢোকার জোরালো দেনদরবার থেকে বিরত থেকেছে। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছে, এ ঘটনা প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক পরিসরেও আওয়ামী লীগ সরকার বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমও বিষয়টি নিয়ে চুপচাপ থাকতে পারে না; তাই সেখানেও চলছে বিশ্লেষকদের মতামতের ভিত্তিতে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

 প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার– জনসংখ্যা, ভৌগোলিক আয়তন এবং অর্থনৈতিক আকারের দিক থেকে ব্রিকস বর্তমান বিশ্বের একটি শক্তিশালী জোট। ২০১৪ সালের হিসাবে, প্রায় ৩২০ কোটি মানুষ নিয়ে ব্রিকসের পাঁচটি সদস্য দেশ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ ধারণ করে। ভৌগোলিকভাবে এরা পৃথিবীর ২৫ শতাংশ এলাকায় ছড়িয়ে আছে এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশও এ দেশগুলোর। বর্তমানে ব্রিকস সম্মিলিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ (আট ট্রিলিয়ন ডলার) নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের মোট পণ্যসেবার ২১ শতাংশ আসে এই পাঁচ দেশ থেকে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্রিকস দেশগুলো বহুদিন ধরেই নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন, ব্রিকস মুদ্রা প্রবর্তন এবং নিজস্ব রিজার্ভের কথা বলে আসছে। এতে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যের অন্যতম হাতিয়ার বলে পরিচিত ডলারের ওপর নির্ভরতাও কমবে। বাংলাদেশের মতো নিজস্ব ধারায় চলতে চাওয়া দেশের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি।

দ্বিতীয়ত, বিশেষত গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার যে হারে বেড়েছে তা বিশ্বের প্রায় সব মহলেরই নজর কেড়েছে। মাথাপিছু আয়ে তো এরই মধ্যে ভারতের মতো বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি– যে কিনা আর মাত্র চার বছরের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে বলে বিভিন্ন পূর্বাভাস বলছে– এ দেশকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। এসবের দৌলতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও ক্রমশ গুরুত্ব পাওয়া শুরু করেছে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের শাসকদের কাছে একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে পরিচিত দেশটি। চীন, ভারতের সঙ্গে সার্ক, বিসিআইএম, বিমসটেকের মতো বহু আন্তর্জাতিক ফোরামে বহু বছর ধরেই মঞ্চের আসন পেয়ে আসছে­ বাংলাদেশ। ফলে ব্রিকসের মতো একটা সম্ভাবনাময় বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের মানুষের নিজ দেশকে দেখতে চাওয়ার আশা বাতুলতা হতে পারে না। এমনটা বলার আরেকটা কারণ হলো, ব্রিকসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন দেশ– ভারত, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি এখন।

তবে যে কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে সদ্য সমাপ্ত শীর্ষ সম্মেলনেই ব্রিকসের সদস্য পদ প্রাপ্তির বিষয়ে আশাবাদ জোরদার হয়ে উঠেছিল তা হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের গত জুনে দেওয়া একটা বক্তব্য। ওই মাসে জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলওর একটা সম্মেলন চলাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্রিকসের তৎকালীন সভাপতি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার একটা বৈঠক হয়। সে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমনটা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রামাফোসা বাংলাদেশকে ব্রিকসে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। আমাদের মনে আছে, ওই বৈঠকের পরই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের সদস্য পদের জন্য আবেদন করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন এটাও বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নিজে তাঁকে জানিয়েছেন যে, তারা নতুন চারটি দেশকে নিতে চান; যে দেশগুলো হলো– সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ হতে পারতো ব্রিকসে যোগদানকারী সপ্তম দেশ পিআইডি

দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলনের পাশাপাশি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের যা বলেছিলেন তাতেও উক্ত আশাবাদ দৃঢ় হয়েছে বললে ভুল হবে না। তাঁর সে ভাষ্য অনুসারে, চীনের প্রেসিডেন্ট নাকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘ব্রিকসে আপনি যাতে জয়েন করতে পারেন, সে জন্য আমাদের সবসময় সমর্থন থাকবে।’

বাস্তবতা হলো, যে ছয়টি দেশ আগামী ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের সদস্য হচ্ছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ তো নেই-ই, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথিত ইন্দোনেশিয়াও নেই। আবার চীনের কাছে বাণিজ্যের পাশাপাশি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্তত পাঁচটি দেশ– যেখানে মার্কিন প্রভাব ক্রমক্ষীয়মান– ব্রিকসের নতুন সদস্যদের মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশ সেখানে স্থান পেল না।

সবারই জানা আছে, আফ্রিকায় চীন বহুদিন ধরেই প্রায় একচেটিয়াভাবে বিনিয়োগ করে চলেছে, যা বিপুল তবে অনেকাংশেই অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চলটিতে মার্কিন তথা পাশ্চাত্যের প্রভাব কমাতে ভূমিকা রাখছে। মধ্যপ্রাচ্যে তো চীনের কূটনীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রেরই তবিয়ত উল্টে যেতে বসেছে। দক্ষিণ আমেরিকায়ও চীনের ব্যাপক বিনিয়োগের কারণে মার্কিন প্রভাব কমছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ওই অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশ আর্জেন্টিনায় চীন বিভিন্ন খাতে ২৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি করেছে, যা একসময় আইএমএফের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল দেশটিকে সে জাল থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে বলে মার্কিন সংবাদমাধ্যমেই খবর বেরিয়েছে।

প্রশ্ন হতে পারে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশও তো চীনের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে চীন ব্রিকসে বাংলাদেশের জন্য দূতিয়ালি না করার কথা নয়। এখানেই আরেকটি সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, ব্রাজিল ও ভারত নাকি নতুন সদস্য নেওয়ার ব্যাপারে শুরুতে আপত্তি জানিয়েছিল। ভারত নাকি আরেকটু বেড়ে নতুন সদস্যদের জিডিপি, গণতন্ত্র এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞামুক্ত থাকার শর্তও দিয়েছে। তবে নতুন সদস্য নির্বাচনে এসব শর্ত খুব একটা বিবেচনায় ছিল বলে অন্তত সদস্য তালিকায় ইরান ও ইথিওপিয়ার মতো দেশ দেখে মনে হয় না। ইরান সেই ১৯৭৯ সাল থেকেই কঠোর থেকে কঠোরতর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে; গণতন্ত্রের লেশমাত্রও সেখানে নেই। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার যুদ্ধপীড়িত দেশ ইথিওপিয়ার জিডিপিও বাংলাদেশের অনেক নিচে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটা বেশ চাউর হয়েছে যে, বাংলাদেশ নাকি ভারতেরই সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর মূলে নাকি আছে চীনের সঙ্গে বর্তমান সরকারের ‘অতিঘনিষ্ঠতা’। যদি তেমনটাই হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে অন্তত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চর্চা নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। 

সাইফুর রহমান তপন : সহকারী সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×