ভূরাজনীতি
পাশ্চাত্য ও পুতিন উভয়কেই দরকার এরদোয়ানের

রাশিয়ার সোচিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন - রয়টার্স
মার্ক চ্যাম্পিয়ন
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান একজন লৌহমানব– সন্দেহ নেই। তবে তাঁর উদ্ভট অর্থনৈতিক নীতির কারণে তিনি দেশকে যেভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছেন, তাতে তাঁকে বাস্তববাদী বলা কঠিন। তবে তাঁর বিদেশনীতিতে নানা দোলাচলের বিষয়টি এর মাধ্যমে বোঝা যায়। কেন তিনি রাশিয়া ও ন্যাটোর প্রেমহীন ত্রিভুজে আটকে আছেন, তারও ব্যাখ্যা আছে এখানে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সোমবার কৃষ্ণ সাগরের পর্যটন শহর সোচিতে যান এরদোয়ান; সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর সরকারের উল্লেখযোগ্য অংশকে। এরদোয়ান তাঁর মতো করেই স্পষ্টভাবে বলেন, ‘প্রত্যেকে’ কিন্তু তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, তারা পুনরায় শস্যচুক্তি নবায়ন করতে পারেন কিনা। যে চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের এক বছরে ইউক্রেন ৩ কোটি ৩০ লাখ টন গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্য কৃষ্ণ সাগর দিয়ে রপ্তানি করতে সক্ষম হয়। এতে বিশ্বে খাদ্যের দামে স্থিতিশীলতা আসে। এর ফলে বিশ্বপরিসরে তুরস্কের ভাবমূর্তিও বৃদ্ধি পায়।
শস্যচুক্তিটি এরদোয়ানের মধ্যস্থতায় গত গ্রীষ্মে স্বাক্ষরিত হয়েছিল; ১৭ জুলাই পুতিন যে চুক্তি থেকে বের হয়ে যান। সোমবার দুই নেতার মধ্যকার ৯০ মিনিটের বৈঠকে এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। এর পরিবর্তে তাঁরা কথা বলেছেন অন্য এক বিষয়ে। সেটা হলো গ্লোবাল সাউথে পুতিনের ভাবমূর্তি রক্ষার এক স্বার্থপর পরিকল্পনা। এর আওতায় রাশিয়া থেকে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য কিনছে কাতার। সেগুলো প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে তুরস্কে, আর বিতরণ করা হবে আফ্রিকার নির্দিষ্ট কিছু দেশে।
তবে রাশিয়ার সোচিতে এরদোয়ানের সফরের উদ্দেশ্য শুধু শস্য খাত নিয়ে আলোচনা নয়। এ বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল মূলত দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। এই বছরের শুরুতে তুরস্কের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এরদোয়ানের পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে পুতিন ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলেন। তার পরও এই তুর্কি নেতা দেখা যাচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দিকেও ঝুঁকছিলেন। বিষয়টি মস্কো ভালোভাবে দেখেনি; এক প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেছে।
২৮ মে চূড়ান্তভাবে জয়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত এরদোয়ান ন্যাটোতে তাঁর ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে সংস্থাটিতে সুইডেনের সদস্যপদ আটকে রাখেন। তুরস্কের অভিযোগ ছিল, সুইডেন কুর্দি ‘সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয়দাতা। ক্রেমলিনের কাছে এর চেয়ে গ্রহণযোগ্য কিছু হতে পারে না। যদিও এটি তুরস্কের ন্যাটো মিত্রদের জন্য ছিল অত্যন্ত বিরক্তিকর। পশ্চিমাবিরোধী একের পর এক বাগাড়ম্বর তিনি তখন উচ্চারণ করতে থাকেন। এমনকি এরদোয়ান তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, তারা ওয়াশিংটনের আদেশ পালন করে।
পুতিন এই অনুগ্রহের প্রতিদান দিয়েছিলেন। তুরস্কের প্রথম পর্যায়ের ভোটের সময় তিনি এরদোয়ানকে এটি ঘোষণা করার সুযোগ দেন যে, ইউক্রেনের শস্যচুক্তির মেয়াদ আরও দুই মাস বাড়িয়েছে রাশিয়া। এরদোয়ানের প্রধান প্রতিপক্ষ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এবং তার বিরুদ্ধে হীন অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ এনেছিলেন।
কিন্তু নির্বাচনে জেতার পর এরদোয়ান পশ্চিমের দিকে কঠোরভাবে ঝুঁকে পড়েন। তিনি কেবল সুইডেনের ন্যাটোর সদস্যপদই অনুমোদন করেননি; বরং এই ইঙ্গিতও দিয়েছেন, ইউক্রেনের জন্যও তিনি একই কাজ করবেন। এর ফলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এরদোয়ানের ওপর খুব ক্ষেপেছিলেন। রাশিয়া তার এই অসন্তোষ প্রকাশ করে জুলাইয়ে শস্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। এর পর তুর্কি পণ্যবাহী জাহাজের জন্য সৈন্য পাঠায় এবং ক্রুদের ফুটেজ প্রচার করে। সে ফুটেজে দেখা যায়, ওই তুর্কি ক্রুরা বন্দুকের কাছে নতজানু হতে বাধ্য হয়েছিল।
এ ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যার খোঁজে পড়ে থাকলেই চলবে না। এরদোয়ান কিন্তু পশ্চিমাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য হলো, বহু-মেরুর বিশ্বে তুরস্ককে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ভারত এবং রাশিয়ার মতো আরও অনেক উদীয়মান পরাশক্তির সঙ্গে একই টেবিলে তুরস্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম। তার মানে, তুরস্ক তার সক্ষমতার চেয়েও বেশি চাইছে এবং শক্তিশালী দেশগুলোর একটাকে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে তা থেকে ফায়দা তুলতে চাইছে।
মোটের ওপর এরদোয়ান এতে সফল হয়েছেন, এমনটাও বলা যায়। তবে এ জন্য তুরস্কের গণতন্ত্রকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস আগে তিনি পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সময় তাঁর এ ভারসাম্যের রাজনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। কারণ তখন পশ্চিমা বাজারের তুরস্কনির্ভরতার বাস্তবতা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ডিসেম্বরের মধ্যে লিরার মান অর্ধেকেরও বেশি কমে গিয়েছিল এবং মুদ্রাস্ফীতি ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কারণ ক্রমবর্ধমান দামের মুখে সুদের হার কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এরদোয়ান নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিদেশি ঋণদাতারা চলে যাওয়ার কারণে বাঁচার জন্য তিনি ধনী উপসাগরীয় দেশগুলোর ঋণের ওপর নির্ভর করেছিলেন। কিন্তু এটা যথেষ্ট ছিল না।
আঙ্কারার ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ হুসেইন বাছগি বলেন, ‘সুদের হার কমিয়ে মূল্যস্ফীতি বাগে আনা তাঁর নীতি ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি এরদোয়ান এখন বুঝতে পারছেন। রাশিয়ান রুবল বা চীনা মুদ্রা নয়; তুর্কিরা তাদের কম মানের মুদ্রায় মার্কিন ডলারে বাণিজ্য করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তাঁর মতে, ‘তুরস্কের পশ্চিমাদের দরকার। কারণ পুঁজি এখনও পশ্চিমে রয়েছে।’ একইভাবে তুরস্ক তার বিমানবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান চাইছে; এ বিমানের প্রযুক্তিও পশ্চিমাদের কাছে। যতক্ষণ তুরস্ক তার নিজস্ব যুদ্ধ বিমান তৈরি করতে না পারছে, ততক্ষণ তার পশ্চিমাদের সাহায্য প্রয়োজন। এরদোয়ান এখন ন্যাটোকে যত খুশি টোপ দিতে পারেন এই বলে যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন যেমন তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো জোটের গুরুত্ব প্রমাণ করেছে, তেমনি তুরস্কের ভৌগোলিক অবস্থান এবং কৃষ্ণ সাগরে তার প্রভাবকেও মিত্রদের গুরুত্ব দিতে হবে।
এত কিছুর পরও তুরস্কের যদি ন্যাটোকে বা যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান প্রয়োজন হয়; প্রয়োজন হয় ইউরোপের বাজার এবং ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি যেখানে কৃষ্ণ সাগর রাশিয়ার একটা হ্রদে পরিণত হবে না; এরদোয়ানেরও কিন্তু রাশিয়ার বাণিজ্য (গত এক বছরে ৮০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। কারণ তুরস্ক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেয়নি), স্বল্পমূল্যে রাশিয়ার গ্যাস, রাশিয়ার পর্যটন (এ বছর ১৫০ শতাংশ বেড়েছে) প্রয়োজন। সর্বোপরি, পুতিনকেও তার চাই। কারণ মার্কিন আধিপত্য এবং ইউরোপীয় উদারনৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সহকর্মী ও যোদ্ধা হিসেবে পুতিনের তুলনা তিনি নিজেই।
সংক্ষেপে, এরদোয়ানের জন্য এই অসুখী ত্রিভুজের যে কোনো দিক থেকে বিচ্ছেদের পরিণাম হবে মারাত্মক।
মার্ক চ্যাম্পিয়ন: ব্লুমবার্গের কলাম
লেখক; ব্লুমবার্গ থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক