ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রযুক্তি

পারমাণবিক জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা

পারমাণবিক জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা

মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

আমি সাধারণত রিকশা বা অটোরিকশায় যাতায়াত করলে চালকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতায় তাদের মনোভাব জানতে চাই। দেশের রিকশাচালক থেকে শুরু করে আমজনতা অনেকেই জানেন পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বিষয়ে। বেশ কয়েকজন রিকশা ও অটোচালকের সঙ্গে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বিষয়ে আলাপ করে জানতে পারলাম, সেখানে নাকি বিশাল আকৃতির অতি উঁচু ধরনের চারটি পারমাণবিক বোমা তৈরি হচ্ছে! এগুলো ফুটলে দেশের অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে তারা খুবই শঙ্কিত। আসলে তারা বোঝাতে চেয়েছেন চারটি ১৭৫ মিটার উঁচু কুলিং টাওয়ারকে। এগুলো মূলত তাপ বর্জনের জন্য ব্যবহৃত হবে এবং এগুলো দিয়ে ধোঁয়ার মতো যা বের হবে তা হলো জলীয় বাষ্প, যা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। এই নেতিবাচক ভাবনা যে শুধু রিকশা ও অটোচালকদের মধ্যে রয়েছে, তা কিন্তু নয়।

সচেতন মহল থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যেও অনেক মিথ রয়েছে। আমি একটি গবেষণায় দেখেছি, পারমাণবিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের মধ্যেও নেতিবাচক অনেক ধারণা রয়েছে। এই নেতিবাচক ধারণা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের ধারণা যত কমানো যায় ততই মঙ্গল। এটা অবশ্যই সম্ভব। পারমাণবিক শিল্পে যারা কর্মরত, তারা এ প্রযুক্তি সম্পর্কে যা জানেন তা সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করে, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রযুক্তির নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরলে অনেক সুফল পাওয়া সম্ভব। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকেও এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত।

শুনতে পাচ্ছি, রূপপুরে প্রথম চুল্লিটির জন্য চলতি সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে পারমাণবিক জ্বালানি আসবে। এ নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সরব ভূমিকা পালন করছে। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম, ঘটনা সত্য। খুবই আনন্দের কথা। আমরা স্বপ্নের রূপপুর বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি।

কভিড কিংবা ইউক্রেন যুদ্ধ– কোনো কিছুই দমাতে পারেনি রূপপুর বাস্তবায়নের অগ্রগতি। সব ঠিক থাকলে এবং আগামী বছর চুল্লিটির পুরো ক্যাপাসিটি পর্যায়ে চালাতে পারলে, প্রথম চুল্লি থেকে নিট বিদ্যুৎ আসবে ১ হাজার ৮০ মেগাওয়াট। চুল্লির ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির মধ্যে ৯৩ শতাংশ দক্ষতা বিবেচনা ও বিদ্যুকেন্দ্রের বিভিন্ন বৈদ্যুতিক মোটর, লাইট, এসি ইত্যাদি চালাতে বিদ্যুৎ ব্যয় হবে প্রায় ১২০ মেগাওয়াট।

পারমাণবিক জ্বালানি তখনই আসে যখন সব ভৌত অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ সমাপ্তির পথে থাকে। শেষ ধাপে আসে পারমাণবিক জ্বালানি। প্রথমে রাশিয়া থেকে বিমানযোগে পারমাণবিক জ্বালানি আসবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এর পর সড়কপথে পৌঁছে যাবে রূপপুরে। কীভাবে এবং কখন জ্বালানি যাবে রূপপুরে, তা আলোচনার বিষয় নয়। পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে বহুজাতিক নিরাপত্তা বাহিনী, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, পর্যবেক্ষক দল ও বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে প্রকল্প স্থানে পৌঁছবে পারমাণবিক জ্বালানি। এটাই রীতি। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি কিংবা তেজস্ক্রিয়তা নির্গমনের কোনো সুযোগ নেই। এটি বিশ্বব্যাপী পরীক্ষিত পদ্ধতি।

আমার আলোচনার মূল বিষয় পারমাণবিক জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি সাশ্রয়ী সরবরাহের নিশ্চিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। একটি চুল্লির আয়ুষ্কাল অন্তত ৬০ বছর। দুটি চুল্লির জন্য ১৮ মাস অন্তর ২৫ টন ইউরেনিয়াম জ্বালানির প্রয়োজন পড়বে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এর দাম হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।

পারমাণবিক জ্বালানির দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক দেশের ওপর এই দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানিনির্ভরতার বিষয়টি নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। এখন প্রযুক্তি এমন হচ্ছে, এক দেশ থেকে চুল্লি নির্মাণ করা হলেও অন্য দেশ থেকে জ্বালানি এনে চুল্লি চালনা করা যাবে। এতে প্রযুক্তিগত কোনো সীমাবদ্ধতা থাকবে না।

পারমাণবিক জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্যোগটির দিকে তাকানো যেতে পারে। তারা চারটি পারমাণবিক চুল্লি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে নিয়েছে। পারমাণবিক জ্বালানির সাশ্রয়ী ও টেকসই সরবরাহ নিশ্চিত করতে তারা বিশ্বের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বহুজাতিক কোম্পানি যেমন– ইউরেনকো (জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য), ওরানো (ফ্রান্স) ও রোসাটমের (রাশিয়া) সঙ্গে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ফুয়েল প্যালেট আমদানি করার চুক্তি করেছে। ফুয়েল প্যালেট হচ্ছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণসহ ছোট সিলিন্ডার আকৃতির আধা ইঞ্চির কম ব্যাস ও উচ্চতাবিশিষ্ট একটি জ্বালানি রড। এ রকম ২৫০টির বেশি রড দিয়ে ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ মিটার উচ্চতার একটি ইউরেনিয়াম জ্বালানি রড তৈরি করা হয়। এই আমদানীকৃত ফুয়েল প্যালেট দিয়ে ইউরেনিয়াম জ্বালানির রড তৈরির জন্য তারা দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠাবে। এর পর ফিনিশড ইউরেনিয়ামের জ্বালানি রড আসবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ফুয়েল প্যালেট থেকে ইউরেনিয়ামের জ্বালানি রড তৈরি করার জন্য নিজস্ব উদ্যোগও নিচ্ছে। যেমনটি আমরা জ্বালানির ক্রুড আমদানি করে ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে পেট্রোল, অকটেন কিংবা ডিজেল তৈরি করি অথবা গাড়ি সংযোজন করি সাশ্রয়ী ও টেকসই সরবরাহের নিমিত্তে।

বিদ্যুতের নিরাপত্তা এবং জলবায়ু মোকাবিলায় আমাদের ভবিষ্যতে আরও পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের দরকার হবে। এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক জ্বালানির সাশ্রয়ী ও টেকসই সরবরাহ হবে আগামীর চ্যালেঞ্জ। সে জন্য দরকার হবে পারমাণবিক জ্বালানির জুতসই পরিকল্পনা।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম: অধ্যাপক ও ফুলব্রাইট স্কলার, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 [email protected]

আরও পড়ুন

×