ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

রাজনীতি

আমাদের লজ্জিত হতে হয়

আমাদের লজ্জিত হতে হয়

সুলতানা কামাল

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০

একেবারে ছোটবেলার অভ্যাস অনুযায়ী সকালবেলা খবরের কাগজ না পড়লে মনে হয়, দিনের শুরুতে কী যেন অসম্পূর্ণ থেকে গেল! দেশ-বিদেশের ভালো-মন্দ নানা খবর জেনে মন কখনও ভালো হয়, কখনও খারাপ হয়ে যায়। ইদানীং খবরের কাগজের কিছু খবর পড়ে ভালো-মন্দ অনুভূতি ছাপিয়ে কেমন যেন শরীর খারাপের একটা অনুভূতি হয়। সাদা কথায় বিবমিষা হয়, আতঙ্কগ্রস্তও হই। কারণ কিছু রাজনৈতিক নেতা তাদের কথাবার্তায় এমন ভাষা ব্যবহার করেন, যাতে মনে হয়, আমরা ‘পাবলিক’কে তারা একেবারেই বোধহীন, রুচিহীন ও মর্যাদাহীন একপাল প্রাণী হিসেবে গণ্য করেন।

ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছি, আমরা কার সঙ্গে কেমন আচরণ করি, কী ভাষায় কথা বলি, তাতে যেমন আমার নিজের শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতিবোধ ও মানের পরিচয় পাওয়া যায়; তেমনি যার সঙ্গে বা সম্পর্কে কথা বলছি তার প্রতি আমার সৌজন্য ও শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ ঘটে। আমাদের রাজনীতিকরা বিরোধীদের বিনাশ চাইতেই পারেন; তাদের নির্মূল করে দেওয়ার জন্য, অপমান করার জন্য যে কোনো পর্যায়ে নামতে পারেন। কারণ তারা রাজনীতিকে মানুষের সার্বিক কল্যাণের সাধনা হিসেবে না দেখে ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার লড়াইয়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছেন। তাই বলে তাদের এমন নিম্ন রুচির ভাষায় কথা বলতে হবে!

মানুষের নিদারুণ কষ্টের উত্তরে যখন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মুখে সেই কষ্টের কোনো স্বীকৃতি দেখি না, বরং দেখা যায় সেই কষ্টকে ছোট করে দেখার প্রবণতা, তখন ক্ষুব্ধ আর হতাশ হতে হয়। ধিক্কার জাগে মনে যে, এদের হাতে আমাদের জীবনের ভার। খাবারের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে বলে মানুষ কষ্টে আছে, মরে যাচ্ছে না! বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল শুধু না মরে যাওয়ার জন্য? এটা ঠিকই, খাদ্যাভাবে না মরে বেঁচে থাকার মতোই তো আমরা রুচির দুর্ভিক্ষে, রাজনীতির অনৈতিকতায় মরে যাই নাই বলেই বেঁচে আছি।

আমি বলেছিলাম, এসব কথা শুনে শঙ্কিত বোধ করি। তার কারণ, রাজনৈতিক এই নেতাদের এসব কথা কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে তাদের মন-মনন, চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে আমাদের কিশোর-যুবকদের মানসিকতা গঠনে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তার ফল তো আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মী ও সমর্থকদের আচরণে টের পাচ্ছি। এর বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে বিত্ত-বৈভব বানানোর অসুস্থ প্রবণতা; যত্রতত্র অভব্য আচরণ থেকে শুরু করে নানা অনাচারে লিপ্ত হওয়া আমাদের যুবসমাজের একটি অংশের আচরণের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবাক হই, শান্তি সমাবেশ থেকে বক্তব্য আসে– বিরোধীদের মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে দেওয়া হবে। এ ধরনের কথা সমাজের কোন স্তরের লোকজনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, সেটি উচ্চারণ করতেও লজ্জা বোধ করি। আমার অনুরোধ, আমাদের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করেন– অন্তত এই পরিচয় যতদিন ধারণ করবেন, এমন ভাষা দয়া করে ব্যবহার করবেন না, যা আমাদের রুচি ও আত্মমর্যাদাবোধকে আহত করে। আমাদের লজ্জিত হতে হয়, এরাই আমাদের নেতা! সুলতানা কামাল: মানবাধিকারকর্মী

আরও পড়ুন

×