করোনাকাল
শিক্ষার্থীর সুস্থতায় অভিভাবকের করণীয়

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম ফরহাদ
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২১ | ১২:০০
মার্চ ২০২০ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঘরে আবদ্ধ থাকার কারণে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেশ কিছু মনোদৈহিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। অভিভাবকরা প্রায়শই তাদের সন্তানদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আজকের এই লেখা।
করোনাসৃষ্ট বর্তমান দুর্যোগময় সময়ে শিক্ষার্থীরা তাদের স্বভাবজাত শারীরিক পরিশ্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অধিকাংশ শহুরে বাচ্চার মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এখন আমরা ডিজিটাল ডিভাইসভিত্তিক পড়াশোনায় চলে গেছি, তার ফলে তাদের দীর্ঘ সময় কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে তাকিয়ে থাকার ফলে তাদের চোখে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। চোখে বাড়তি চাপ পড়ায় তাদের মাথাব্যথা হচ্ছে। শুয়ে-বসে থাকায় তাদের ক্ষুুধামন্দা হচ্ছে। রাতের বেলায় বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকা এবং সকাল বেলা ঘুমানোর চেষ্টার কারণে তাদের শারীরবৃত্তীয় চক্র বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়া যেসব শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা হচ্ছে- পেশিশক্তির হ্রাস, প্রাণচাঞ্চল্য হ্রাস, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, হাত-পা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।
করোনাকালীন মানসিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একাকিত্ববোধ। অভিভাবকদের অনেকেই অভিযোগ করেন, ছাত্ররা আগের উদ্যম হারিয়ে ঘরের এক কোণে ঝিম মেরে বসে থাকে। এর কারণ ঘরের বদ্ধ পরিবেশে দীর্ঘদিন অবস্থান। তাদের এ ধরনের ব্যবহারের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে বয়ঃসন্ধিজনিত সমস্যা। বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা সাধারণত শিক্ষার্থীদের ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যেই দেখা যায়। এই বয়ঃসন্ধিকালে আমাদের সন্তানদের আত্মপরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করে। অর্থাৎ তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা তৈরি হয়। তার পছন্দ-অপছন্দ, সে কী চায়, সেগুলো আস্তে আস্তে গড়তে শুরু করে। তার নিজের জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এ দৃষ্টিভঙ্গিটা বই পড়ে, পরিবারের সবার আচার-আচরণ, ব্যবহার, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের উপদেশ ও বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথন ইত্যাদি থেকেই গড়ে ওঠে। বয়ঃসন্ধিকালে সে স্বাধীনভাবে ভাবতে শুরু করে। সে কী পারবে, সে কী খাবে, কাদের সঙ্গে মিশবে; সেটার জন্য সে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। এ সময়ে সে পরিবারের সদস্যদের বাইরেও বন্ধুদের সঙ্গে সময় দেওয়াটাকে পছন্দ করে। এ বয়সটাতে সন্তানরা অভিভাবকের চাইতে তাদের বন্ধুবান্ধবের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। এজন্য অনেক বাবা-মা অভিযোগ করেন, তাদের সন্তানরা তাদের অধীনতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আসলে এটাই স্বাভাবিক। আমরা জানি, বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনের কারণে তার শারীরবৃত্তীয় নানা পরিবর্তন হয়। সে কারণে তার মনমেজাজ দ্রুত ওঠানামা করে।
এ থেকে উত্তরণের জন্য সন্তানকে ঘরে একটা ইতিবাচক পরিবেশ দিতে হবে। এজন্য প্রথম যে কাজটা করতে হবে, তা হচ্ছে ধৈর্য ধরা ও সহনশীল হওয়া। অভিভাবক ও বাড়ির অন্য সদস্যদের শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন এবং করোনাকালীন মানসিক অস্থিরতা নিরসনে তাদের সঙ্গে সময়োপযোগী আচরণ করতে হবে। আপনার সন্তানকে সময় দিন। আপনি যতই ব্যস্ত হন না কেন, সারাদিন যা করছেন, যে পরিশ্রম ও যে উপার্জন করছেন- তা আপনার সন্তানের জন্যই। সন্তানকে বোঝার সহজ উপায় হচ্ছে, তার সঙ্গে গল্প করুন। তার সঙ্গে ঘরোয়া খেলা খেলুন। এমনভাবে খেলার ছলে, তার সঙ্গে কথোপকথন, তার সান্নিধ্যে তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার সঙ্গে গল্পের ছলে জেনে নিন সে কার সঙ্গে মিশছে, কী আলোচনা করছে, কীভাবে সে বিকশিত হচ্ছে।
করোনাকালীন একাকিত্ব কাটাতে সন্তানকে তার শখের কাজটা করতে দিন। সে ছবি আঁকতে পছন্দ করলে তার জন্য ছবি আঁকার ব্যবস্থা করে দিন, যদি সে ছবি তুলতে পছন্দ করে তাকে ছবি তোলার জন্য সহযোগিতা করুন। সে বই পড়তে পছন্দ করলে তাকে বই কিনে দিন। তার যদি কোনো গাছ বা পট প্লান্টের শখ থাকে, তাকে গাছ কিনে দিন। সে হয়তো একটা ছোট্ট বিড়াল অথবা পোষা পাখিতে খুশি হবে। সন্তানকে ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রেখে তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এই ব্যস্ততার সঙ্গে সঙ্গে তার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করবেন, যেমন- তোমার বিড়াল আজকে কী করেছে, তোমার পাখি আজকে কী করেছে, তুমি আজকে কী ছবি এঁকেছ; অর্থাৎ সে যেন নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে। তাহলেই সে আপনার কাছে আসবে, মন খুলে কথা বলবে। তার মন ও শরীরের মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে সেগুলো আপনি বুঝতে পারবেন।
তার ভালো কাজের প্রশংসা করুন। সে যে আপনার কথা শুনছে, আপনার আদেশ পালন করছে, সে যে ভালো কিছু করছে; তার প্রশংসা করুন। তাকে বুঝতে দিন, আপনি তাকে খেয়াল করছেন। আপনার অনাগ্রহ ও বাস্তবতায় সে মনে করবে, তার ভালো-মন্দে আপনার কিছু যায় আসে না। এই সময় বাচ্চারা খুব স্পর্শকাতর থাকে। তারা বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। সেটা দেখুন ও তাকে অবশ্যই উৎসাহিত করুন এবং খারাপ কিছু দেখলে তাকে বুঝিয়ে বলুন। তাকে বলুন, সে যেটা করছে তা তার পারিবারিক ঐতিহ্য ও পারিবারিক মর্যাদার সঙ্গে কতটা যায়।
এবার আসি শারীরিক বিষয়ে। বাড়ন্ত বয়সের শিক্ষার্থীদের প্রথম যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে সুষম খাবার। আপনাকে অবশ্যই তাদের প্রাত্যহিক খাবার তালিকায় ডিম, দুধ, শাকসবজি রাখতে হবে। চেষ্টা করতে হবে, দিনের এক বেলা পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেতে; বিশেষ করে রাতের খাবারটা। টেবিলে অন্যান্য যেসব খাবার আছে, তা দেখে সে নতুন খাবার খেতে শিখবে। এ বয়সে অনেক শিশুই সবজি খেতে চায় না। তাকে বোঝাতে হবে, তোমার বাড়ন্ত শরীরের জন্য, সুস্থ চোখের জন্য সবজি খেতে হবে। করোনার জন্য এই সময়ে শিক্ষার্থীদের আমরা বাইরে বেড়াতে নিতে পারছি না, তারা খোলা মাঠে দৌড়ে খেলাধুলা করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে তাকে আমরা নিয়মিত ঘরে বসেই খালি হাতে ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করব। এই বয়সের বাচ্চাদের যান্ত্রিক বা ওজন দিয়ে ব্যায়াম করার দরকার নেই, কোনো দামি জিমের দরকার নেই। অভিভাবকবৃন্দ ইউটিউব বা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সাইসাইজের তালিম নিতে পারেন। হাঁটার জন্য বিকেলে বা সন্ধ্যায় অথবা রাতের খাবারের পরে ছাদে যেতে পারেন। ছাদে গিয়ে সন্তানকে দিগন্ত দেখার চেষ্টা করতে বলুন।
অভিভাবকরা যদি আলোচ্য বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে আমার পরামর্শ বা উপদেশ অনুযায়ী নিজ নিজ সন্তানকে লালন-পালন করেন, তবে অবশ্যই আমরা তাদের এমন দুঃসময়েও দেহমনে স্বাস্থ্যবান সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।
অধ্যক্ষ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল
মডেল কলেজ