ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

তথ্যপ্রযুক্তি

অনিরাপদ ঘরে নিরাপদ ইন্টারনেট

অনিরাপদ ঘরে নিরাপদ ইন্টারনেট

রাশেদ মেহেদী

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০

অনিরাপদ ঘরে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন না। ভার্চুয়াল জগতে আপনার ব্যবহূত ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার কিংবা প্রতিষ্ঠানের সার্ভার হচ্ছে একেকটি ঘর। সাইবার দুনিয়ায় নিরাপদ থাকতে হলে আপনার ব্যবহূত ডিভাইসের নিরাপত্তা তাই সবার আগে।
স্মার্ট ডিভাইসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এখানে ব্যবহূত কিছু অ্যাপ বা সফটওয়্যার। ডিভাইসের প্রাথমিক নিরাপত্তা দেয়াল তৈরি করেন ডিভাইস নির্মাতা এবং অপারেটিং সিস্টেম প্রোভাইডার। তারা যৌথভাবে একটি নিরাপত্তা সফটওয়্যার মূল অপারেটিং সিস্টেমের সঙ্গে 'ইনবিল্ট' বা সংযুক্ত নিরাপত্তা সফটওয়্যার দিয়ে দেন। একটা সুরক্ষিত ভবনে ঢোকার সময় নিরাপত্তারক্ষী তল্লাশি ও স্ক্যানার নিয়ে মালপত্র পরীক্ষা করেন। ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেমের 'ইনবিল্ট' সিকিউরিটি ফিচারও ঠিক সে কাজটিই করে। স্পাইওয়্যার, ম্যালওয়্যার ও বটনেটের মতো চোরকে খুঁজে তার প্রবেশ আটকে করে দেয় ইনবিল্ট ফিচার। কিন্তু ঘরের দরজায় তালা দেওয়ার দায়িত্ব ব্যবহারকারীর। আপনি প্যাটার্ন, পাসওয়ার্ড, ফেস আইডি কিংবা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে সে তালা দিতে পারেন। ডিভাইসে ঢোকার সময় এই তালা না খুলে ঢোকা যাবে না। একইভাবে ডিভাইসে যেসব অ্যাপ ব্যবহার করেন, যেমন- মেসেঞ্জার, মেসেজ, গ্যালারি, হোয়াটসঅ্যাপ এসবেও পৃথকভাবে প্যাটার্ন, পাসওয়ার্ড বা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো ফিচার ব্যবহার করুন। এই তালা দিলে ডিভাইসে কোনো স্পাইওয়্যার কিংবা ম্যালওয়ারের মতো চোর ঢুকলেও হুট করে অ্যাপগুলোতে অ্যাকসেস নিতে পারবে না। তার জন্য এই পাসওয়ার্ডও তাকে ভাঙতে হবে। যদি ডিভাইস কেউ ছিনতাই বা চুরি করে, তাহলে সে এটা খুলতেও পারবে না, ব্যবহারও করতে পারবে না। ব্যবহার করতে চাইলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। ডিভাইসটি চালু রাখলে এর আইএমইআই নম্বর কিংবা লোকেশন ট্র্যাক করে চোরকে শনাক্ত করা সম্ভব।
থার্ড পার্টি নিরাপত্তা অ্যাপ বা ফিচার ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাবধান থাকতে হবে। কারণ, থার্ড পার্টি অ্যাপে অনেক সময় স্পাইওয়্যার কিংবা ম্যালওয়্যারের মতো চোরকে ছদ্মবেশে লুকিয়ে রাখা হয়। অতএব, অপারেটিং সিস্টেমের সঙ্গে ইনবিল্ট নিরাপত্তা ফিচার আছে- এমন ডিভাইস কেনাটাই ভার্চুয়াল জগতে সুরক্ষার প্রথম ও প্রধান শর্ত। ল্যাপটপ বা ডেস্কটপের ক্ষেত্রে লাইসেন্সড অপারেটিং সিস্টেম নিলে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া যায়। কারণ, সেখানে 'প্যাটার্নাল প্রোটেকশন' থাকে, ভার্চুয়াল জগতের ভয়ংকর হাইজ্যাকার র‌্যানসমওয়্যার প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা থাকে, যেটা পাইরেটেড বা ক্লোন অপারেটিং সিস্টেমে থার্ড পার্টি লাইসেন্সড অ্যান্টিভাইরাসও কখনও নিশ্চিত করতে পারবে না।
আমাদের দেশে ব্যবহারকারীদের অনিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার কিংবা সাইবার জগতে বিপন্ন অবস্থার জন্য দায়ী মূলত অনিরাপদ ডিভাইস। যেহেতু আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষেরই উপযুক্ত নিরাপত্তা ফিচার সংবলিত স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই; ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপে লাইসেন্সড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারের সামর্থ্য কম, অভ্যাসও নেই, সে কারণে একটা নতুন ডিভাইস কিনে ইন্টারনেট সংযোগ নিয়েই আমরা ভার্চুয়াল জগতে অনিরাপদ যাত্রা শুরু করি। এখন এই অনিরাপদ ঘরে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার কতটা সম্ভব?
ইন্টারনেট সংযোগ হচ্ছে মূলত একটি মহাসড়ক। এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতে আপনার ঘরে ডাটা পরিবহন করা হয়। আপনি ফেসবুকে যে পোস্ট দেন, মেসেঞ্জারে যে চ্যাট করেন, ই-মেইলে যে ফাইল পাঠান, ওটিটি অ্যাপ ব্যবহার করে যে কল দেন; এটা টেক্সট হতে পারে, ভয়েস হতে পারে, ছবি এবং ভিডিও হতে পারে। সবকিছুই ভার্চুয়াল জগতে ডাটা হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে এই ডাটা পরিবহনের কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই। শত শত টেরাবাইট ডাটা আপনার ঘরের ইন্টারনেট সংযোগ থেকে শুরু করে সাবমেরিন কেবল দিয়ে প্রতি মুহূর্তে বিশ্বময় পরিভ্রমণ করছে। সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য জরুরি হচ্ছে সাবমেরিন কেবল থেকে বের হয়ে আরও সুনির্দিষ্ট ও ছোট ছোট যে সড়ক বা ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ডিভাইসে সংযুক্ত থাকে, তার মসৃণ গতিপথ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এই দায়িত্ব ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের। ইন্টারনেট সংযোগ মসৃণ করার জন্য গ্রাহক অনুপাতে পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইথ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যেমন, কোনো আইএসপি যদি এক জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ দিয়ে একশ গ্রাহককে সেবা দেয়, সেটা যে আদর্শ গতি নিশ্চিত করবে, এক হাজার গ্রাহককে সেবা দিলে সেই আদর্শ গতি নিশ্চিত হবে না। আবার নিরাপত্তার জন্য আইএসপিদের স্বয়ংক্রিয় স্পাইওয়্যার, ম্যালওয়্যার ফিল্টার সিস্টেম থাকতে হবে। শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার নিশ্চিতে অভিভাবকদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা 'প্যাটার্নাল কন্ট্রোল সিস্টেম' সংযোগ বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। এর পাশাপাশি একটি লগ সার্ভার থাকতে হবে। এর মাধ্যমে জানা যাবে গ্রাহকরা কোন ধরনের সাইটে কী মাত্রায় লগইন করছেন। ফলে এই লগ সার্ভার সাইবার অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও বড় সুরক্ষা দেয়।
সর্বশেষ কনটেন্ট বা ইন্টারনেটের বিষয়বস্তুতে আসি। এটি নিয়েই সরকারি পর্যায়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসাধারণ উদ্ভাবনী চিন্তার পাশাপাশি গালি, উস্কানি, ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়টিও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে গেছে। ভার্চুয়াল জগতে কনটেন্ট সম্রাট মূলত ফেসবুক, গুগল, টুইটার, অ্যামাজনের মতো কোম্পানিই। যেখানে আমাদের মতো দেশের সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা আর আমাদের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট নিশ্চিত করা এক কথা নয়। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বৈশ্বিক মোড়ল কনটেন্ট অপারেটরদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরেকটি বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাও সহজ নয়, বরং বিপুল অর্থের অপচয়ের আশঙ্কাই বেশি। অতএব নিজেদের স্বতন্ত্র প্ল্যাটফর্ম উদ্ভাবন করতে হবে।
এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে আপনার ঘরে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। ইন্টারনেট সংযোগে প্যাটার্নাল কন্ট্রোল সিস্টেমের মাধ্যমে সন্তানের ব্যবহূত ডিভাইস থেকে ক্ষতিকর সাইট বা কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা। এর পাশাপাশি বাংলায় নিজেদের অনেক বেশি কনটেন্ট এবং স্বতন্ত্র কনটেন্ট প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুদের মানসিক বিকাশ হয়, সুস্থ বিনোদন নিশ্চিত করে- এমন কনটেন্ট অনেক বেশি তৈরি করতে হবে। বৈশ্বিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সঠিক কনটেন্ট ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে। বিশেষত আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে নিয়মিত সচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইনের প্রয়োগ সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন হতে হবে সরকারকে। যারা আইন তৈরি করেন, তাদের আইনের অপপ্রয়োগ রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে সবার আগে। আর যারা আইন প্রয়োগ করেন, তাদের যথাযথ প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ সম্পর্কে সংবেদনশীল ও শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সমালোচনা আর গালির পার্থক্য বুঝতে হবে। সত্যিকার অর্থে কোনটা ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ, সেটা জানতে হবে এবং এই বিদ্বেষ ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাংবাদিক

আরও পড়ুন

×