ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

খাদ্যবর্জ্য, গ্রিনহাউস গ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

খাদ্যবর্জ্য, গ্রিনহাউস গ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ড. আবেদ চৌধুরী ও জাকিয়া বেগম

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০

আধুনিক খাদ্য ব্যবস্থার একটা খারাপ দিক হলো খাবারের অপব্যবহার ও উচ্ছিষ্টকরণ। এমন সময় ছিল, যখন শুধু দিনের খাবার আহরণ করতেই মানুষকে সারাদিন হাঁটতে হতো। পাড়ি দিতে হতো দুর্গম পথ। এখন আধুনিকীকরণের কল্যাণে এক শ্রেণির মানুষ ঘরে বসেই পেয়ে যায় অঢেল খাবার। এসব মানুষ তার অল্প অংশই খায়, বাকিটা যত্রতত্র ফেলে দেয়। এই ফেলে দেওয়া খাবার থেকে সৃষ্টি হয় পর্বতপরিমাণ উচ্ছিষ্ট। এই যত্রতত্র খাবার ফেলে দেওয়ার সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব জড়িত। কারণ, ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের বিষবাষ্প এখন আমাদের গ্রাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমরা আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তর বহু পেছনে ফেলে এসেছি। আমাদের এসেছে প্রাচুয। আর যারা প্রাচুর্যের মানুষ; উচ্ছিষ্ট তারাই তৈরি করছেন। আমেরিকা ও ইউরোপের মতো বিত্তশালী অঞ্চলে মানুষ যা খায়, তার চেয়ে ফেলেই দেয় বেশি। যে ফেলে, সে ভাবে- দায় থেকে সে এখন মুক্ত। কিন্তু যা সে চায় না, এমন সব বস্তু সে ফেলবে কোথায়? সে ভাবে, এই উন্মুক্ত পৃথিবী তার বর্জ্য ফেলার জায়গা। না হয় সে ডাস্টবিনেই ফেলল, কিন্তু তা থেকে বর্জ্য যাবে কোথায়? বিশ্বব্যাপী প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের খুচরা মূল্যের ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন খাবার ফেলে দেওয়া হয়। ল্যান্ডফিলগুলোতে যাওয়া ৫১ শতাংশেরও বেশি আবর্জনা কম্পোস্টযোগ্য। যেমন খাদ্যবর্জ্য, কাগজ, বাগানের ময়লা, গাছের ডাল, লতাপাতা, কাঠ ইত্যাদি।
দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বব্যাপী খাদ্যবর্জ্যের পরিবেশগত ব্যয় প্রায় আকাশচুম্বী এবং ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন টনের মতো কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতি বছর বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়। যার জন্য দায়ী এই ফসল ফলানো, ফসল কাটা, পরিবহন, খাদ্যের বাণিজ্যিক সংরক্ষণ ও প্যাকেজিং এবং নষ্ট হওয়া খাবারের মাধ্যমে। আরও বেশি উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, একবার এই খাদ্যবর্জ্য ল্যান্ডফিলগুলোতে পৌঁছলে সেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়া ও জীবাণুঘটিত কারণে খাবার থেকে পচা গন্ধ বের হয়। সৃষ্টি হয় পরিবেশ বিধ্বংসী মিথেন গ্যাস। ঢাকার অদূরে মাতুয়াইলে সম্প্রতি এমন পরিবেশ বিধ্বংসী খাদ্য উচ্ছিষ্টতার পাহাড় থেকে নির্গত মিথেন পরিমাপ করা গেছে। স্যাটেলাইট থেকে মাপা এই ডাটাবেজে দেখা যায়, দুই লাখ গাড়ির সমতুল্য মিথেন ঘণ্টায় সেই ল্যান্ডফিল থেকে নির্গত হচ্ছিল। কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে মিথেনের উষ্ণতা ধরে রাখার ক্ষমতা ২১ গুণ। যার অর্থ বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ঈঙ২-এর চেয়েও মিথেন বেশি প্রভাব ফেলে। পৃথিবীব্যাপী যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হলেও সঠিক বণ্টন বৈষম্যের কারণে বিশাল পরিমাণ খাদ্যের অপচয় হতে থাকে। ইউএনইপির মতে, ৮-১০ শতাংশ বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয় এই অপচয়কৃত খাদ্যের পচন থেকে।
এখন জানা যাক খাদ্যবর্জ্য হ্রাস করার উপায়। অনুমান করা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ ১৪ শতাংশ নির্গমন কমানো সম্ভব হবে শুধু খাদ্যের সঠিক ব্যবহার ও বণ্টনের মাধ্যমে।
খাদ্যবর্জ্য হ্রাস করার সর্বপ্রথম পর্যায় হলো কী পরিমাণ খাদ্যবর্জ্য উৎপাদিত হয়, তার একটি সঠিক ডাটাবেজ তৈরি করা। যেমন, খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত মাথাপিছু কত কেজি খাদ্যবর্জ্য তৈরি হয়, তার হিসাব রাখা। শুধু নির্ভরযোগ্য ডাটা দিয়ে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) ১২ দশমিক ৩-এর অগ্রগতি ট্র্যাক করতে সক্ষম হবো। যার লক্ষ্য খুচরা ও ভোক্তা পর্যায়ে মাথাপিছু বিশ্বব্যাপী খাদ্যবর্জ্য অর্ধেক এবং উৎপাদন, সরবরাহ শৃঙ্খলাসহ খাদ্যবর্জ্য হ্রাস। 'খাদ্যবর্জ্য সূচক' প্রতিবেদনের লক্ষ্য এসডিজি ১২ দশমিক ৩-এর লক্ষ্যকে সমর্থন করা। এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যাপক খাদ্যবর্জ্য তথ্য সংগ্রহ, বিশ্নেষণ এবং মডেলিং উপস্থাপন করে থাকে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যবর্জ্যের একটি নতুন ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে এবং দেশগুলোর বর্জ্য পরিমাপে একটি পদ্ধতি প্রকাশ করেছে। যার মাধ্যমে গৃহস্থালিতে খাদ্য পরিষেবা এবং উৎপাদন পর্যায়ে ২০৩০-এর দিকে জাতীয় অগ্রগতি ট্র্যাক এবং এসডিজি ১২ দশমিক ৩-এ তা রিপোর্ট করা হবে।
খাদ্যবর্জ্যের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করার পর সেগুলোকে ব্যবস্থাপনার আওতায়
আনতে হবে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপায় বর্জ্যগুলোকে কম্পোস্টিং করে ব্যবহারযোগ্য জৈব সারে পরিণত করা। বাংলাদেশে সব ধরনের বর্জ্যের শেষ আবাসস্থল ল্যান্ডফিল। ল্যান্ডফিলে যাওয়ার আগেই বর্জ্যগুলোকে বাসাবাড়ি ও অন্যান্য স্থান থেকে সংগ্রহ করতে হবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যবর্জ্যের বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে। তাহলে মানুষ অর্থের বিনিময়ে হলেও তাদের বর্জ্যকে আলাদা সংগ্রহ করে রাখবে।
ঢাকার মাতুয়াইলে যে স্যানিটারি ল্যান্ডফিল তৈরি করা হয়েছে, সেটি তার নির্দিষ্ট ধারণ ক্ষমতা অনেক আগেই পার করে ফেলেছে। নতুন করে তার পাশেই জায়গা বাড়ানো হয়েছে ময়লা ফেলার জন্য। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এই ল্যান্ডফিলে ময়লা ফেলার জায়গার সংকুলান হয় না। মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিলে প্রতিদিন যে খাদ্যবর্জ্য জমা হয়, তা যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয় যেমন- রিসাইক্লিং বা ময়লাগুলোকে আলাদা জমা করে সেখান থেকে কম্পোস্টিংয়ের মাধ্যমে জৈব সার তৈরি করা হলে একদিকে যেমন আবর্জনার স্তূপ কমবে, অন্যদিকে জৈব সারের চাহিদা মিটবে। এ ছাড়া যে খাদ্য বর্জ্যগুলো ইতোমধ্যে পচে গিয়ে অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে মিশে মিথেন গ্যাস নির্গমন করছে, সেখানে একটি প্লান্ট বা প্রজেক্ট স্থাপন করে মিথেন গ্যাস সংগ্রহের মাধ্যমে জ্বালানি উপযোগী গ্যাসে পরিণত করা গেলে একদিকে যেমন বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ কমবে, অন্যদিকে জ্বালানির চাহিদাও মিটবে।
জানা উচিত, পরিবারে কী পরিমাণ খাবার যথেষ্ট এবং সে অনুযায়ী বাজার করা। পুষ্টিজ্ঞান বাড়িয়ে সে অনুযায়ী সুষম খাবার খেতে হবে। এমনভাবে নিজের জীবন গঠন করতে হবে, যাতে অতিরিক্ত খাবার রান্না করার মাধ্যমে উচ্ছিষ্ট না হয়। খাবারের চরম অপচয় হয় বিয়েবাড়িতে। এখানে ব্যয়বহুল খাবার কমাতে হবে। প্রচুর অপচয় হয় রেস্টুরেন্টেও। বাইরে গেলে যেটুকু খেতে পারবেন, সেটুকুই অর্ডার করুন।
ঝুড়িতে বর্জ্য ফেলার নিয়ম করুন। বাড়িতে যদি জায়গা থাকে, তাহলে বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট করার ব্যবস্থা করুন। এলাকায় নিরাপদ দূরত্বে বর্জ্য ফেলার জায়গার ব্যবস্থা এবং দরকার হলে নাগরিক কমিটি গঠন করে পাড়ায় পাড়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তদারকি করুন। স্কুলের ছাত্রদের খাদ্যবর্জ্য ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে শিক্ষা দিন। খাবারের এই উচ্ছিষ্ট বর্জ্যকে ঘরেই প্রসেস করতে হবে। ঘরে ঘরে এই অপচয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে হবে। বর্জ্যকে যথাযথভাবে বর্জন করা এক বিশাল সমস্যা, এটা কোনো হেলাফেলার ব্যাপার নয়। এই যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব জড়িত। কারণ, ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের বিষবাষ্প এখন আমাদের গ্রাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
লেখকদ্বয় যথাক্রমে জলবায়ু বিজ্ঞানী ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী

আরও পড়ুন

×