ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

প্লাস্টিক দূষণ

সময়ে এক ফোঁড় দিন

সময়ে এক ফোঁড় দিন

২৫ কেজির বাগাইড় মাছ

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২১ | ১২:০০

বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সোমবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন হলেও বিস্মিত নই। প্রতিবেদনের এই ভাষ্যের সঙ্গেও আমরা একমত যে, করোনা সংকট প্রাকৃতিক নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও প্লাস্টিক দূষণ পরিস্থিতির অবনতিই ঘটিয়েছে। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি মাস্ক, গ্লাভসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীতে প্লাস্টিকের বাহুল্য দৃশ্যমান। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে 'অনলাইন শপিং' সংস্কৃতিও এই খাতের পণ্য ও পরিবহনে ব্যবহূত প্লাস্টিক ও পলিথিনের বর্জ্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বস্তুত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক অথচ নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের ব্যবহার গত ১৫ বছরে তিন গুণ বেড়ে যাওয়ার যে চিত্র গবেষণায় উঠে এসেছে, তাতে জনধারণাই 'একাডেমিক্যালি' প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই গবেষণা-সংশ্নিষ্ট সবাইকে আমরা এ জন্য সাধুবাদ জানাই।
গবেষণা প্রতিবেদনটি সামনে রেখে এ ক্ষেত্রে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রমাবনতিশীল এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে কীভাবে? আমরা মনে করি, প্রথমেই নজর দিতে হবে প্লাস্টিক দূষণের 'হটস্পট' ঢাকা মহানগরীতে। আলোচ্য গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে প্লাস্টিক দূষণ বেশি। শহরাঞ্চলের গড় মাত্রা থেকেও ঢাকা মহানগরীর দূষণ কয়েক গুণ বেশি। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, নদীমাতৃক ও বন্যাবহুল বাংলাদেশে প্লাস্টিক বা অন্যান্য জলজ দূষণ এক স্থানে আবদ্ধ থাকে না। আমাদের মনে আছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল- বাজার থেকে কেনা ১৫ প্রজাতির দেশীয় মাছের পরিপাকতন্ত্রে 'মাইক্রোপ্লাস্টিক' বা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা পাওয়া গেছে। আমাদের আশঙ্কা- এতে করে ভূমি, জলাশয় ও বায়ুমণ্ডলও অনিবার্যভাবে দূষণের শিকার হচ্ছে। ঢাকা মহানগরী এলাকায় প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা গেলে একদিকে যেমন দূষণের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে আসবে, অন্যদিকে অন্যান্য এলাকার জন্যও প্রতিষ্ঠিত হবে অনুসরণযোগ্য উদাহরণ।
বাড়তি আশঙ্কার বিষয়, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে সচেতনতা ও সক্রিয়তা ক্রমে বাড়লেও আমাদের দেশে বিষয়টি এখনও গবেষণা বা সংবাদমাধ্যমের আলোচনার বিষয় হিসেবেই রয়েছে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর প্লাস্টিক ও পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কেউ দ্বিমত না করলেও বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটি অনিষ্পন্নই রয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপীই প্লাস্টিকের অপব্যবহার ও অতিব্যবহার রোধে যে উদ্যোগ ও প্রচারণা চলছে; বাংলাদেশ যেন তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। বিভিন্ন সময়ই গবেষণা প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে হতাশাজনক চিত্রই ফুটে ওঠে।
আমরা স্বীকার করি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যারা প্রথম প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করেছিল, বাংলাদেশ ছিল তার প্রথম সারিতে। আমাদের মনে আছে, ২০০২ সালেই ৫৫ মাইক্রোনের নিচে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন পক্ষ ও নাগরিকরা সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এর সুফলও আমরা দেখেছি। কিন্তু নজরদারির অভাবে ফের বাজার ছেয়ে গেছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে। আমাদের এও মনে আছে, ২০১০ সালে আরেকটি আইনের মাধ্যমে পলিথিন বস্তার স্থলে চটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সেই আইনও ক্রমে কাগুজে দলিলে পরিণত হয়েছে। আলোচ্য গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০০৫ সাল থেকে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে প্লাস্টিক দূষণ। পলিথিন ও প্লাস্টিক পুনর্চক্রায়নের উদ্যোগ অবশ্য গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে ও বেড়েছে। তাও অনেক ক্ষেত্রে বুমেরাং হয়েছে। অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্যের সঙ্গে হাসপাতাল বর্জ্য মিশিয়ে যে পুনর্চক্রায়ন চলে এবং সেখান থেকে তৈরি হওয়া নানা প্লাস্টিক পাত্রও যত্রতত্র পরিত্যক্ত হয়ে দূষণ বাড়িয়ে চলেছে। এর ফলে ক্যান্সারসহ নানা ভয়াবহ রোগ-ব্যাধির ঝুঁকি তৈরি হয়।
আমরা মনে করি, বিলম্বে হলেও প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। নিষিদ্ধ মাত্রার পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণনের ওপর নজরদারি জোরদার করতেই হবে। একই সঙ্গে চাই জনসচেনতা। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের হাত ধরে প্লাস্টিক দূষণও যদি বাড়তে থাকে, তাহলে পরিবেশ, কৃষি ও স্বাস্থ্যের পাশাপাশি উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিও পড়তে পারে ঝুঁকির মুখে।

আরও পড়ুন

×