মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রাধানগর

আব্দুল হাই আল-হাদী
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০
রাধানগরের যুদ্ধে বিজয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ, এখানকার যুদ্ধে বিশ্বখ্যাত গুর্খা রেজিমেন্টের অফিসারসহ ১০৩ জন শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন শাহাদাতবরণ করেন। আহত হন অনেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিত্রবাহিনী ছাড়া মুক্তিবাহিনী পুরো এলাকাটি জয় করতে সমর্থ হয়। আর এ বিজয়ের পরম্পরায় পুরো ডাউকি-জৈন্তাপুর-দরবস্থ-হরিপুর-খাদিমনগর হয়ে সিলেট বিজয় ত্বরান্বিত হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সিলেট শহর থেকে শুরু করে তামাবিল বিওপি পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এর মধ্যে রাধানগর ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী।
রাধানগর ছিল মুক্তিবাহিনীর ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তাপুর সাব-সেক্টরভুক্ত এলাকা। অক্টোবর পর্যন্ত এ এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে প্রথাগত আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হয়নি। এ সময় ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরে প্রথাগত আক্রমণ করার জন্য নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের ওপর দায়িত্ব পড়ে।
মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিল যুদ্ধ অধিনায়কদের ডাউকির বিএসএফের সীমান্ত ঘাঁটিতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। শাফায়াত জামিল সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। ৫ নভেম্বর, ১৯৭১ আলফা কোম্পানিও সেখানে পৌঁছায়। শাফায়াত জামিল কর্নেল রাজ সিংহের কাছে গিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে কথা বলেন। সিদ্ধান্ত হয়, রাধানগরের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণের। প্রণয়ন করা হয় রণকৌশল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, নভেম্বরের কয়েক দিন যুদ্ধ হয়। চূড়ান্ত আক্রমণ করতে ২৯ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা ডেলটা, তৃতীয় বেঙ্গলের আলফা ও গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাধানগরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কমান্ডারের নির্দেশ পাওয়ামাত্র তারা বিভিন্ন দিক দিয়ে পাকিস্তানিদের রাধানগর অবস্থানে আক্রমণ চালান। এক ঘণ্টার মধ্যে গোটা এলাকা ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিল। সন্ধ্যার মধ্যেই বেশ কিছু এলাকা মুক্ত হয়ে গেল। রাত ১০টায় পাকিস্তানিরা হঠাৎ ছোটখেল আক্রমণ করে বসে। এ আক্রমণ ছিল কল্পনাতীত। রাত প্রায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলে। অবশেষে একসময় পাকিস্তানিদের দিক থেকে গোলাগুলির তীব্রতা কমতে থাকে। রাত ১২টায় একদম বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝতে বাকি রইল না যে পাকিস্তানিরা রণেভঙ্গ দিয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধারা এরপর রাধানগরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ৩০ নভেম্বর সকাল ৭টার মতো হবে। এ দিন ও ক্ষণটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা গোটা রাধানগর শত্রুমুক্ত করে রাধানগর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের সব উপদলের কমান্ডাররা ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিজয় উদযাপন করেন।
ছোটখেল ও রাধানগর দখল করায় পুরো তামাবিল, জাফলং বাজার, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, খাদিমনগর, দরবস্থ, কানাইঘাট, ভোলাগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট সদর, বিশ্বনাথ-ছাতক, সুনামগঞ্জ এলাকাসহ বৃহত্তর সিলেট জেলার প্রতিটি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে।
১ ডিসেম্বর, ১৯৭১। মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ওয়েট ও বিএসএফের মেজর রাও লে. কর্নেল এসআইএম নুরুন্নবী খানকে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর মধ্যে গোয়াইনঘাট দখলের নির্দেশ দেন। জিওসি জেনারেল গুরবক্স সিংয়ের হাতে লেখা একটি অপারেশনাল অর্ডার হস্তান্তর করেন। তাকে সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে এ এলাকায় সব ধরনের অপারেশন পরিচালনার জন্য অপারেশনাল কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট ও ২৫ আসাম রেজিমেন্ট দুটোকেই তার অধীনে দেওয়া হয়। স্থানীয় বিএসএফের সব ইউনিটকেও তার অধীনে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোনো অফিসার মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের অপারেশনাল কমান্ডার নিয়োজিত হওয়ার ঘটনা এখানেই ঘটেছিল। এমনকি বাঙালি কোনো অফিসার গুর্খা রেজিমেন্ট কমান্ড করার একমাত্র বিরল সম্মানের ঘটনা এখানেই ঘটেছিল।
আব্দুল হাই আল-হাদী :লেখক ও পরিবেশকর্মী
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সিলেট শহর থেকে শুরু করে তামাবিল বিওপি পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এর মধ্যে রাধানগর ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী।
রাধানগর ছিল মুক্তিবাহিনীর ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তাপুর সাব-সেক্টরভুক্ত এলাকা। অক্টোবর পর্যন্ত এ এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে প্রথাগত আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হয়নি। এ সময় ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরে প্রথাগত আক্রমণ করার জন্য নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের ওপর দায়িত্ব পড়ে।
মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিল যুদ্ধ অধিনায়কদের ডাউকির বিএসএফের সীমান্ত ঘাঁটিতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। শাফায়াত জামিল সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। ৫ নভেম্বর, ১৯৭১ আলফা কোম্পানিও সেখানে পৌঁছায়। শাফায়াত জামিল কর্নেল রাজ সিংহের কাছে গিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে কথা বলেন। সিদ্ধান্ত হয়, রাধানগরের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণের। প্রণয়ন করা হয় রণকৌশল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, নভেম্বরের কয়েক দিন যুদ্ধ হয়। চূড়ান্ত আক্রমণ করতে ২৯ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা ডেলটা, তৃতীয় বেঙ্গলের আলফা ও গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাধানগরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কমান্ডারের নির্দেশ পাওয়ামাত্র তারা বিভিন্ন দিক দিয়ে পাকিস্তানিদের রাধানগর অবস্থানে আক্রমণ চালান। এক ঘণ্টার মধ্যে গোটা এলাকা ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিল। সন্ধ্যার মধ্যেই বেশ কিছু এলাকা মুক্ত হয়ে গেল। রাত ১০টায় পাকিস্তানিরা হঠাৎ ছোটখেল আক্রমণ করে বসে। এ আক্রমণ ছিল কল্পনাতীত। রাত প্রায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলে। অবশেষে একসময় পাকিস্তানিদের দিক থেকে গোলাগুলির তীব্রতা কমতে থাকে। রাত ১২টায় একদম বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝতে বাকি রইল না যে পাকিস্তানিরা রণেভঙ্গ দিয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধারা এরপর রাধানগরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ৩০ নভেম্বর সকাল ৭টার মতো হবে। এ দিন ও ক্ষণটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা গোটা রাধানগর শত্রুমুক্ত করে রাধানগর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের সব উপদলের কমান্ডাররা ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিজয় উদযাপন করেন।
ছোটখেল ও রাধানগর দখল করায় পুরো তামাবিল, জাফলং বাজার, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, খাদিমনগর, দরবস্থ, কানাইঘাট, ভোলাগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট সদর, বিশ্বনাথ-ছাতক, সুনামগঞ্জ এলাকাসহ বৃহত্তর সিলেট জেলার প্রতিটি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে।
১ ডিসেম্বর, ১৯৭১। মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ওয়েট ও বিএসএফের মেজর রাও লে. কর্নেল এসআইএম নুরুন্নবী খানকে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর মধ্যে গোয়াইনঘাট দখলের নির্দেশ দেন। জিওসি জেনারেল গুরবক্স সিংয়ের হাতে লেখা একটি অপারেশনাল অর্ডার হস্তান্তর করেন। তাকে সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে এ এলাকায় সব ধরনের অপারেশন পরিচালনার জন্য অপারেশনাল কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট ও ২৫ আসাম রেজিমেন্ট দুটোকেই তার অধীনে দেওয়া হয়। স্থানীয় বিএসএফের সব ইউনিটকেও তার অধীনে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোনো অফিসার মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের অপারেশনাল কমান্ডার নিয়োজিত হওয়ার ঘটনা এখানেই ঘটেছিল। এমনকি বাঙালি কোনো অফিসার গুর্খা রেজিমেন্ট কমান্ড করার একমাত্র বিরল সম্মানের ঘটনা এখানেই ঘটেছিল।
আব্দুল হাই আল-হাদী :লেখক ও পরিবেশকর্মী